হ-বাংলা নিউজ:
– খান শওকত, সাবেক সাহিত্য সম্পাদক (২০০৭-০৮, এবং ২০০৯-১০ কমিটি)
১৯৯০ সালে নিউইয়র্কে এলাম। তখন সংগঠন বলতে বাংলাদেশ সোসাইটি, লীগ অব আমেরিকা, ৩/৪ টি রাজনৈতিক দল, ৫/৬ টি সাংস্কৃতিক সংগঠন, ১টি নাট্যদল এবং ৩/৪টি আন্চলিক সংগঠন। বাংলাদেশ সোসাইটি তখন অন্যতম বৃহৎ সংগঠন। এটি ১৯৭৫ সালে গঠিত হয়।
১৯৭৫ থেকে প্রায় ১৯৯১ পর্যন্ত সোসাইটিতে সবাই সদস্য হতেন নিজর টাকায়, এবং ভোট দিতেন নিজের পছন্দের প্রার্থীকে। প্রথমদিকে কমিটি গঠনের সময় শুধুমাত্র সভাপতি এবং সাধারন সম্পাদক পদে নির্বাচন হতো। নির্বাচিত হবার পর তারা দুজন তাদের পছন্দের সদস্যদেরকে বাকী পদগুলোতে নিয়োগ দিতেন। এভাবে তারা দুই বছরের জন্য দায়িত্ব পালন করতেন। তখন এ সোসাইটি ছিলো এলিট সোসাইটির হাতে। বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত হলেও সবাইকে সদস্যপদ দেয়া হতোনা। এই বিষয়টা অনেক সাধারন প্রবাসীকে কষ্ট দিতো। তাদের বক্তব্য ছিলো, যে সংগঠনের নাম বাংলাদেশ সোসাইটি, সে সংগঠনে সদস্যপদ সকল বাংলাদেশির জন্য উন্মুক্ত করা উচিত। এ দাবিতে যখন ঐক্যবদ্ধ হলেন, তখন সদস্যপদ ওপেন করে দেয়া হলেও সদস্যপদ এবং প্রার্থীদের নোমিনেশান ফিস অনেক বাড়িয়ে দেয়া হলো।
ওপি ওয়ান, ডিভি ওয়ান সহ নানান ভিসায় আগতদের জন্য নিউইয়র্ক কম্যুনিটিতে ১৯৯০ থেকে প্রবাসীদের সংখ্যা বেড়ে গেলো। নিয়মিত পত্রিকা প্রকাশ শুরু হলো। সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রবাসীদের দাবিতে এ সোসাইটি গনমানুষের সংগঠন করার জন্য ভোটার বানানো শুরু হলো পুরোদমে। এই সুযোগে এমন কিছু মানুষ সামনে চলে এলেন যাদের নেতৃত্বের যোগ্যতা এবং লেখাপড়ার তেমন যোগ্যতা না থাকলেও ভালো টাকার মালিক তারা। তাদের টাকায় ভোটার বানানো শুরু হলো। তারা বড় বড় পদে প্রার্থী হওয়া শুরু করলেন। প্রবাদ ছড়িয়ে পড়লো “যার বেশী টাকা, সে বড় নেতা।”
নিজ টাকায় ভোট বানানোর এই প্রতিযোগিতায় আইডেন্টিটি ক্রাইসিস এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেলো যে সোসাইটির সভাপতি হতে গেলে তাকে কয়েক লক্ষ ডলার খরচ করতে হচ্ছে! এই বাস্তবতায় দেখা যাচ্ছে, প্রতি কমিটিতে অপেক্ষাকৃত ছোট পদগুলোতে অনেক বেশি যোগ্য ব্যাক্তি নির্বাচিত হচ্ছেন, কিন্তু তারা সেভাবে মূল্যায়িত হচ্ছেন না! কারণ, যিনি লাখ ডলার ব্যয় করে বড় পদে নেতা হয়েছেন, তিনি চাইছেন তার নিজের মতো এ সংগঠনকে পরিচালিত করতে। তখনই শুরু হয় সাংবিধানিক দ্বন্দ্ব! নির্বাচনের সময় প্যালেন গঠনের সময়, নোমিনেশানের খরচে যদি কেউ সহায়তা দিয়ে থাকেন, অথবা কম্যুনিটি পলিটিক্সের কারনে, দলীয় রাজনীতির সখ্যতার কারণে, ধীরে ধীরে গ্রুপিং তৈরি হয়। যার হাতে টাকা বেশি, তার হাতেই একটু দরীদ্র সদস্যরা ধরা থাকেন। সব মিলিয়ে গ্রুপিং সংকট, ইগো সমস্যা এবং অনভিজ্ঞ নেতৃত্বের জন্য সংগঠনটির কাজে আর প্রত্যাশিত সফলতা আসে না! এইজন্য ৫০ বছর বয়সী এ সংগঠনের সফলতা সেভাবে আসেনি।
একটি সংগঠন পরিচালিত হয় সংবিধান মোতাবেক। কোন কর্মকর্তার কোনো কাজকে যদি সংগঠনের জন্য ক্ষতিকর বলে বিবেচিত হয়, অবশ্যই তার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ নিয়ে কারন দর্শানোর নোটিশ দিতে হবে এবং তাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে। অভিযুক্ত কর্মকর্তা কারন দর্শানো নোটিশের জবাব দেবেন এবং তা বোর্ডে আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে, সে সিদ্ধান্ত সাধারণ সদস্যদেরকে অবগত করতে হবে। এটি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এমন একটি সহজ ও স্বাভাবিক প্রক্রিয়াও যখন না মেনে গায়ের জোরে কারো উপর ষড়যন্ত্রমূলক শাস্তি দেয়া হয়, তখন ঐ সংগঠনের হাজার হাজার সাধারন সদস্য হতবাক হয়ে যায়, তারা কষ্ট পায়, একসময় তারা সংগঠনের উপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, এবং ধীরে ধীরে সংগঠনটি গ্রহনযোগ্যতা হারায়। এই সংগঠনে এমন অনিয়ম হয়েছে বেশ কয়েকবার। আমি অন্তত তিনটি ঘটনার স্বাক্ষী! কোনরকম কারন দর্শানোর নোটিশ ছাড়া কর্মকর্তাদেরকে শাস্তি দেয়া হয়েছে। শেষমেষ এ ধরনের ঘটনা আদালতে পৌঁছেছে, টক অব দ্য টাউন হয়েছে, চতুর্দিকে সমালোচনার ঝড় উঠেছে, মিডিয়ায় লেখালেখি হয়েছে, অনেকের সাথে সুসম্পর্ক নষ্ট হয়েছে, কমিটি সঠিকভাবে কাজ করতে পারেনি, সংগঠন ও নেতৃত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, সাধারণ সদস্যরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন, এবং সংগঠনের ইমেজ প্রচন্ডভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এমনসব ঘটনার জন্য এ সংগঠনটি এমন একটা অবস্থায় পতিত হয় যে, সাধারণত সভায় কোরাম হওয়াও কঠিন হয়ে পড়েছিলো একসময়। তেমন পরিস্থিতির মধ্যে বেশ কয়েকবার পড়েছে এ সংগঠনটি। যার মূল কারণ, “যার বেশী টাকা, সে বড় নেতা”! মনে রাখতে হবে সাংগঠনিক অভিজ্ঞতা না থাকলে, শুধু টাকাই যখন যোগ্যতা হয়ে দাঁড়ায়, তখন এ ধরনের অচল পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়াটা স্বাভাবিক। দেড় যুগেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ সোসাইটির কোন অফিস ভাড়া লাগেনা, বরং প্রতিমাসে নিজেদের ভবনের ভাড়া থেকে নিয়মিত আয় হয়, এবং তহবিলে মোটা অংকের সন্চয় আছে। তাই টাকার পেছনে না ছুটে, সাংগঠনিক সফলতার জন্য চিন্তা করা দরকার।
এই বিশাল কম্যুনিটির কাছে আমার অনুরোধ, এ সংগঠনকে সফল এবং ডায়নামিক করার জন্য কিছু চ্যালেন্জিং সিদ্ধান্ত নিন। সদস্যপদের ফিস কমিয়ে দিন, যে কোন পদে নোমিনেশান ফিস সর্বোচ্চ ১০০ ডলার করুন, সদস্যপদ অনলাইনে করার পদ্ধতি ওপেন করে দিন, অনলাইনে পরামর্শ গ্রহণের সুযোগ খুলে দিন সবার জন্য। এখানে অনেক টাকার মালিক অথচ অশিক্ষিত অথবা সাংগঠনিকভাবে অনভিজ্ঞ, এমন ধরনের নেতার দরকার নেই। এখানে শিক্ষিত এবং মূলধারায় প্রতিনিধিত্ব করার মতো সক্ষম নেতৃত্ব দরকার। তাহলে কম্যুনিটি উপকৃত হবে এবং নতুন প্রজন্ম এগিয়ে এসে দায়িত্ব নিতে আগ্রহী হবে। তাদের জন্য সুযোগ তৈরি করুন। অন্যদিকে, যারা কখনোই সোসাইটির সাথে ছিলো না এমন কেউ, যার বেশি ডোনেশন দেবার ক্ষমতা আছে, অথবা যে আপনার জন্য নির্বাচনে খাটাখাটনি করেছে এজন্য ঋন শোধ করতে আপনি তাকে “বোর্ড অব ট্রাস্টির সদস্য” করবেন না। ট্রাস্টি বোর্ডে তাকেই নিন যিনি সোসাইটিতে অতীতে নির্বাচিত দায়িত্ব পালন করেছেন, কারণ এ সংগঠন বিষয়ে তিনি অভিজ্ঞ এবং পরীক্ষিত ব্যাক্তি। এ ধরনের কিছু ডাইনামিক সিদ্ধান্ত নিন, দেখবেন সোসাইটি সেই আগের মতো সুনামের সাথে প্রশংসিত হবে। এ বিষয়ে নবগঠিত বাংলাদেশ সোসাইটির প্রাক্তন কর্মকর্তাদের সংগঠনের পরামর্শ নিতে পারেন, তাতে সোসাইটি উপকৃত হবে। ১৯৭৫ সালে গঠিত সোসাইটির বয়ষ যখন অর্ধশত বছর পার করছে, তখন এই ২০২৫ সালে প্রাক্তন কর্মকর্তারা মিলে বিশ্ববিদ্যালয় এ্যালামনাই এসোসিয়েশনের মতো একটি সংগঠন গড়ে তুলেছেন এবং সেই কমিটিতে আমাকে কাজ করার সুযোগ দেওয়ার জন্য আমি সংশ্লিষ্ট সকলকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। সবার জন্য শুভ কামনা রইলো। বাংলাদেশ সোসাইটির কল্যান হোক এবং এ কম্যুনিটি সফল হোক।
