গত বছরের ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ৮ আগস্ট গঠন হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, যার প্রধান উপদেষ্টা নিযুক্ত হন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এই সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই দেশে একের পর এক আন্দোলনের সৃষ্টি হয়, যা সরকারের জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করেছে।
এ আন্দোলনগুলোর মধ্যে ৭৬ শতাংশই হয়েছে বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের ব্যানারে, যেখানে ৩২ শতাংশ আন্দোলন শিক্ষাসংশ্লিষ্ট, ৮ শতাংশ শ্রমিক আন্দোলন এবং ১০ শতাংশ অন্যান্য পেশাজীবী সংগঠনের আওতায়।
এছাড়া ৯০ শতাংশ আন্দোলন বন্ধ হয়ে গেলেও ১০ শতাংশ এখনও চলছে। ৫ আগস্ট থেকে ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত ১২৬টি আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করে এই তথ্য পাওয়া গেছে।
এছাড়া খুন, ধর্ষণ, নারী নির্যাতন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আবাসন নিশ্চিতকরণসহ বিভিন্ন দাবিতে বেশকিছু আন্দোলন চলমান রয়েছে।
এ আন্দোলনগুলো নানা বাহারি নামের সংগঠনের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। গত সাত মাসে এসব আন্দোলনের হটস্পট হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে জাতীয় প্রেস ক্লাব, বাংলাদেশ সচিবালয়, রেলভবন, কমলাপুর রেলস্টেশন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, শাহবাগ মোড় এবং জাতীয় জাদুঘর প্রাঙ্গণ। সবচেয়ে বেশি আন্দোলন হয়েছে জাতীয় প্রেস ক্লাবে, যেখানে বেসরকারি শিক্ষকসহ একাধিক সংগঠন তাদের দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন করছে। সরকারি কর্মচারীদের আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল হিসেবে সচিবালয় পরিচিতি পেয়েছে।
রেলওয়ে কর্মচারীদের আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল হয়েছে রেলভবন ও কমলাপুর রেলস্টেশন, আর শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের প্রধান কেন্দ্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, শাহবাগ মোড় ও জাতীয় জাদুঘর প্রাঙ্গণ।
এছাড়া চাকরিচ্যুত কর্মচারী, শহিদ পরিবার পুনর্বাসন, মজুরি বৃদ্ধি, শিক্ষাসংশ্লিষ্ট আন্দোলন, সংখ্যালঘু ও ধর্মীয় সংগঠন এবং পরিবহন খাতের দাবির সাথে যুক্ত আন্দোলনগুলো রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ব্যাপকভাবে ঘটছে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার শেখ সাজ্জাত আলী যুগান্তরকে বলেন, “কোনো সংগঠন তাদের অধিকার আদায়ের জন্য দাবি জানাতে পারে, তবে গত কয়েক মাসে আন্দোলনের যে প্রক্রিয়া দেখা গেছে তা যথাযথ নয়। আন্দোলন শুরু হয়ে রাস্তায় দখল করা হচ্ছে, যা মানুষের ভোগান্তি বাড়াচ্ছে। আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে আমি বলব- দাবির জন্য রাস্তা নয়, আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধান করুন।”
গত আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আন্দোলনের সংখ্যা দ্রুত বেড়েছে। ১৩ থেকে ২৫ আগস্টের মধ্যে ছিল সবচেয়ে বেশি কর্মসূচি, এরপর সেপ্টেম্বরে কিছুটা কমেছে আন্দোলনের সংখ্যা। অক্টোবর মাসে আবার আন্দোলনের চাপ বেড়ে যায়, বিশেষ করে সরকারি কর্মচারী ও শিক্ষাসংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলো। নভেম্বর মাসে আন্দোলন কিছুটা কমলেও, ৭-১৬ নভেম্বর বড় কিছু কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয়েছে।
ডিসেম্বরে তিতুমীর কলেজ এবং শিক্ষক সংগঠনের আন্দোলন রাজপথ উত্তাল করে রেখেছিল। চলতি বছরের জানুয়ারিতে আন্দোলনের সংখ্যা আবারও বৃদ্ধি পায়, বিশেষ করে ২৫-৩০ জানুয়ারি বেশ কিছু কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে সরকারকে বড় ধাক্কা দিতে একটি পরাজিত রাজনৈতিক শক্তি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির চেষ্টা করেছিল, এবং চলতি মাসের শুরু থেকে নারী ও শিশু নির্যাতন এবং ধর্ষণের বিরুদ্ধে আন্দোলন হচ্ছে।
এছাড়া বনানীতে সড়ক দুর্ঘটনায় পোশাক শ্রমিক নিহত হওয়ার ঘটনায় সড়ক অবরোধে সোমবার পুরো রাজধানী অচল হয়ে পড়েছিল।
চাকরি পুনর্বহালের আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন চাকরিচ্যুত পুলিশ সদস্য, সেনা সদস্য, বিজিবি, ব্যাটালিয়ন আনসার, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও আইএফআইসি ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারী, গ্রামীণফোনসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা।
সরকারি চাকরিজীবীদের দাবির মধ্যে রয়েছে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বছর করা, ১১-২০ গ্রেডের সরকারি কর্মচারীদের বেতন বৈষম্য নিরসন এবং পদোন্নতির দাবি, উপসচিব পদে ক্যাডারদের সমান সুযোগের দাবি, এবং কর্মকর্তাদের বদলি নীতি সংস্কারের দাবি।
শ্রমিক আন্দোলনের মধ্যে রয়েছে নির্মাণ শ্রমিকের নিরাপত্তা, বাসস্থান এবং রেশনিং ব্যবস্থা চালু করা, রিকশা ও ইজিবাইক শ্রমিকদের লাইসেন্স এবং রুট পারমিট, এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি।
শিক্ষাসংশ্লিষ্ট আন্দোলনের মধ্যে রয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ, প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন বৈষম্য দূরীকরণ, মেডিকেল টেকনোলজি ও ফার্মেসি শিক্ষার্থীদের বৈষম্য দূরীকরণ, এবং ৪৬তম বিসিএসের প্রিলি উত্তীর্ণদের লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণের দাবি।
সংখ্যালঘু ও ধর্মীয় সংগঠনের দাবির মধ্যে রয়েছে সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন, সনাতন ধর্মীয় গুরু চিন্ময় দাসের মুক্তি, এবং বৈষম্য দূরীকরণের দাবি। পরিবহণ খাতের দাবির মধ্যে রয়েছে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালু রাখা, হালকা মোটরযান চালকদের জন্য সাদা প্লেট সংযুক্ত গাড়ি ভাড়ায় চালানোর অনুমতি এবং সিএনজিচালকদের রেজিস্ট্রেশন ও পুলিশের হয়রানি বন্ধ করা।
গণঅভ্যুত্থানের পর পেশাজীবী সংগঠনগুলোর মধ্যে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া সংগঠনগুলোর মধ্যে রয়েছে চাকরিচ্যুত পুলিশ সদস্য, উপসচিব, ব্যাটালিয়ন আনসার, বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি, গ্রাম পুলিশ সমন্বয় কমিটি এবং বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পনা স্বেচ্ছাসেবী (মহিলা) দাবি বাস্তবায়ন পরিষদ।
