ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সফলতা, ব্যর্থতা ও ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ

হ-বাংলা নিউজ:

নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস, যিনি বর্তমানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, তার সরকারের ছয় মাস পূর্ণ হতে চলেছে। এই সময়ে সরকারের কার্যক্রম নিয়ে নানা আলোচনা, সমালোচনা ও বিশ্লেষণ চলছে। অনেকেই সরকারের দোষত্রুটি বের করতে ব্যস্ত, তবে আমি চাই সরকারের পেশাদার ও নির্মোহ বিশ্লেষণ হোক। বিশেষত, দেশের মধ্যে ও বাইরে যেসব চক্র অন্তর্বর্তী সরকারকে অক্ষম করে তোলার চেষ্টা করছে, তাদের সম্মিলিতভাবে প্রতিহত করা দরকার। অন্যথায়, আগামী নির্বাচনের সঠিকতা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা নিয়ে সংশয় রয়ে যাবে।

৫ আগস্ট, ২০২৩ ছিল সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার পতনের ঐতিহাসিক দিন। এর পরবর্তী কয়েকদিনে বিপ্লবী জনতার চাপে এই সরকার পতন ঘটে। ড. ইউনূস সে সময়ে প্যারিসে ছিলেন, যার কারণে সরকারের দায়িত্ব গ্রহণে কিছুটা বিলম্ব হয়। তবে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বের আহ্বানে তিনি সম্মত হন এবং দেশের জনগণও তাকে সমর্থন জানায়। ৮ আগস্ট, ২০২৩-এ তিনি শপথ গ্রহণ করেন প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে, যা ইতিহাসের একটি মাইলফলক হয়ে দাঁড়ায়।

ড. ইউনূসের সরকার দায়িত্ব নেওয়ার সময় দেশের মধ্যে কিছু জরুরি দাবি ছিল। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য দ্রুত পদক্ষেপ, গণ-অভ্যুত্থানে যারা শহীদ হয়েছেন তাদের খুনিদের বিচারের মুখোমুখি আনা, আহতদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা, এবং আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ফ্যাসিস্ট কর্মকাণ্ডে জড়িতদের শাস্তি নিশ্চিত করা। এই দাবিগুলোর প্রতি জনগণের প্রত্যাশা ছিল বিশাল এবং তা ছিল যথার্থ।

সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল বিপর্যস্ত। শেখ হাসিনার সরকার লুটপাট ও দুর্নীতির কারণে ব্যাংকগুলোর তহবিল প্রায় খালি হয়ে গিয়েছিল, এবং ভারতসহ অন্যান্য দেশের ঋণ পরিশোধের চাপ ছিল। এরপর শুরু হয় ভয়াবহ বন্যা, যখন ভারত ত্রিপুরার ডুমুর বাঁধ খুলে দিলে স্রোতের মতো পানি বাংলাদেশে প্রবাহিত হয়, এবং একযোগে লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ে। তবে, এই দুর্দিনে সরকারের পাশাপাশি বহু সামাজিক সংগঠনও মানুষের পাশে দাঁড়ায়।

এমন অবস্থায় আমরা দেখলাম, বিভিন্ন ছদ্মাবরণে আগের সরকারের সমর্থকরা দাবি আদায়ের নামে মাঠে নামছে। তাদের দাবি-দাওয়া দেখতে দেখতে জনগণ ভুলে গেছে আগের সরকারের সময়ে যারা আওয়ামী লীগের সঙ্গী ছিল তাদের অবস্থান। বাস্তবতা হলো, ভারতে পালিয়ে গিয়েছে এক শতাংশেরও কম, বাকিরা দেশের মধ্যেই রয়েছে। এসব পুরানো আওয়ামী সমর্থকেরা এখন সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে।

এরপর আনসারদের কর্মসূচি থেকে শুরু করে শ্রমিকদের আন্দোলন, গার্মেন্টস ভাঙচুর, শিক্ষার্থীদের অটোপাশের দাবিতে আন্দোলন—এসব কিছু সরকারকে অস্থিতিশীল করার উদ্দেশ্যে ঘটে। এসব আন্দোলনের পেছনে খুঁজে পাওয়া গেছে কিছু আওয়ামী দলের লোকজনকে, যারা সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চালাচ্ছিল। এর মধ্যে একটি বড় ষড়যন্ত্র শুরু হয় ইসকন নেতা চিন্ময় কৃঞ্চ দাসের গ্রেফতারকে কেন্দ্র করে, যেখানে দেশি-বিদেশি চক্র সাম্প্রদায়িক অশান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করে। ভারতের টেলিভিশন চ্যানেল রিপাবলিক বাংলা মিথ্যা সংবাদ প্রচার করে এই সাম্প্রদায়িক অশান্তি ছড়াতে থাকে।

এছাড়া, ভারতীয় গণমাধ্যমসহ কিছু দেশি-বিদেশি চক্র একযোগে ইউনূস সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাতে থাকে, যা সরকারকে ব্যর্থ করতে তাদের সর্বাত্মক চেষ্টা ছিল। এই ষড়যন্ত্রের মধ্যে ৪৯টি ভারতীয় গণমাধ্যম ১২ আগস্ট থেকে ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত মিথ্যা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এসব মিডিয়া পণ্য হিসেবে কেবল গুজব ও বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে, কিন্তু বাস্তবতা কিছুই ছিল না।

তবে, এখনো আমরা দেখতে পাচ্ছি, এসব ষড়যন্ত্র থেমে যায়নি। বরং নতুন নতুন আক্রমণ আসতে পারে, যার মোকাবিলা করা কঠিন। চেনা শত্রু মোকাবিলা যতটা সহজ, অচেনা শত্রু মোকাবিলা ততটাই কঠিন। তবে, আমরা নৈরাশ্যবাদী হতে চাই না, বরং আশাবাদী থাকতে চাই। কারণ, আশাই মানুষের শক্তি।

এখন প্রশ্ন হলো, আমরা কী চাই? আমরা সবাই একটি সুন্দর বাংলাদেশ চাই, যেখানে মানুষের ভোট ও ভাতের অধিকার থাকবে। দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতি হবে, এবং ক্ষমতায় আসা কিংবা টিকে থাকার জন্য কোনো দল বা গোষ্ঠীর গোলামি করবে না। জনগণ স্বাধীনভাবে কথা বলবে, এবং গণমাধ্যমও ক্ষমতাকে প্রশ্ন করতে সক্ষম হবে। ফ্যাসিস্ট, খুনি ও লুটেরা সবাই বিচারের মুখোমুখি হবে। নির্বাচন শিগগিরই অনুষ্ঠিত হবে এবং সৎ, যোগ্য ও দক্ষ ব্যক্তিরা মনোনয়ন পাবেন।

এমন একটি বাংলাদেশ নির্মাণ করতে হলে, আমাদের উচিত হবে ড. ইউনূস সরকারের দোষত্রুটি নিয়ে অযথা সময় নষ্ট না করে, ঐক্যবদ্ধভাবে গণ-অভ্যুত্থানের শক্তি একত্রিত করে প্রয়োজনীয় সংস্কার ও নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাওয়া।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *