হ-বাংলা নিউজ: আজ ১৯ জানুয়ারি মঙ্গলবার মহান স্বাধীনতার ঘোষক, বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ৮০তম জন্মবার্ষিকী। তিনি ছিলেন বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা, বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রতীক। ১৯৩৬ সালের এমনি এক শীতার্ত দিনে তিনি বগুড়ার গাবতলী উপজেলায় বাগবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। মাতা-পিতা তখন আদর করে নাম রাখেন কমল। দেশ, মাটি ও মানুষের জন্যে আমৃত্যু নিবেদিতপ্রাণ এই ব্যক্তিত্বের পরিচিতি সর্বজনবিদিত। দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়ক, অসাধারণ দেশপ্রেমিক, অসম সাহসী ও সহজ-সরল ব্যক্তিত্বের প্রতীক হিসেবে জিয়াউর রহমান ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
তার বাবা মনসুর রহমান একজন রসায়নবিদ হিসেবে কলকাতাতে সরকারী চাকুরী করতেন। মাতা-পিতা তখন আদর করে নাম রাখেন কমল। দেশ, মাটি ও মানুষের জন্যে আমৃত্যু নিবেদিতপ্রাণ এই ব্যক্তিত্বের পরিচিতি সর্বজনবিদিত। দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়ক, অসাধারণ দেশপ্রেমিক, অসম সাহসী ও সহজ-সরল ব্যক্তিত্বের প্রতীক হিসেবে জিয়াউর রহমান ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
তার শৈশবের কিছুকাল বগুড়ার গ্রামে ও কিছুকাল কলকাতাতে কেটেছে। দেশবিভাগের পর (১৯৪৭) তার বাবা করাচি চলে যান। তখন জিয়াউর রহমান কলকাতার হেয়ার স্কুল ত্যাগ করেন এবং করাচি একাডেমী স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৫৩ সালে তিনি ঐ স্কুল থেকে তার মাধ্যমিক পরীক্ষা দেন এবং তারপর করাচিতে ডি.জে. কলেজে ভর্তি হন। ১৯৫৩ সালে তিনি কেকুলে পাকিস্তান মিলিটারী একাডেমীতে শিক্ষানবিস অফিসার হিসেবে যোগ দেন। ১৯৫৫ সালে তিনি সেকেন্ড লেফটেনেন্ট হিসেবে কমিশন প্রাপ্ত হন। তিনি সেখানে দুই বছর চাকুরি করেণ, তারপর ১৯৫৭ সালে ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে বদলি হয়ে আসেন। তিনি ১৯৫৯ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগে কাজ করেন। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে তিনি খেমকারান সেক্টরে একটি কোম্পানির কমান্ডার ছিলেন এবং তার কোম্পানি যুদ্ধে বীরত্বের জন্য যে সব কোম্পানি সর্বাধিক পুরষ্কার পায়, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল। ১৯৬৬ সালে তিনি পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমীতে একজন প্রশিক্ষক হিসেবে দ্বায়িত্ব পান। সে বছরই তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের কোয়েটা স্টাফ কলেজে কমান্ড কোর্সে যোগ দেন। ১৯৬৯ সালে তিনি জয়দেবপুরস্থ সেকেন্ড ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড হিসেবে নিয়োগ পান। উচ্চ প্রশিক্ষণের জন্য তিনি পশ্চিম জার্মানীতে যান। ১৯৭০ সালে একজন মেজর হিসেবে তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং চট্টগ্রামে অষ্টম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড হিসেবে নিয়োগ পান।
২৫ মার্চের কালরাত্রিতে ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী যখন এদেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপর বর্বরের মতো ঘৃণ্য হামলা চালায় তখন এর আকস্মিকতায় দিশেহারা হয়ে পড়ে সবোর্স্তরের জনগণ। ১৯৭১-এর ২৬ মার্চ ঢাকায় পাকিস্তানী বাহিনীর বর্বর আক্রমণের পর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করে ২৭ মার্চ চট্টগ্রামস্থ কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঐতিহাসিক ঘোষণা দেন। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠিত হলে তিন সেক্টর কমান্ডার নিযুক্ত হন। তিনি সেনা সদস্যদের সংগঠিত করে পরবর্তীতে তিনটি সেক্টরের সমন্বয়ে জেড ফোর্সের অধিনায়ক হিসেবে যুদ্ধপরিচালনা করেন।
বৃহত্তর চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কুমিল্লা জেলার কিয়দংশে মুক্তিপাগল মানুষকে মেজর জিয়া সংগঠিত করেন এবং পরবর্তীতে ‘জেড ফোর্সের’ অধিনায়ক হিসেবে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের মাধ্যমে নেতৃত্ব দেন সেই রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে। দীর্ঘ নয় মাস মরণপণ লড়াই করে অজির্ত হল সবুজ জমিনে ওপর রক্তলাল সূর্যখচিত পতাকাসমৃদ্ধ স্বাধীন বাংলাদেশ- আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি। লাখো শহীদের পবিত্র রক্ত আর হাজার হাজার মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অজির্ত হল এদেশের স্বাধীনতা। গণতন্ত্র এখানে সুপ্রতিষ্ঠিত হবে, শোষন বঞ্চনার অবসান ঘটবে, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জিত হবে এবং আত্মনির্ভরশীল ও মর্যাদাসম্পন্ন জাতি হিসেবে আমরা বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াব- এই ছিল সেদিনের স্বপ্ন, মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।
স্বাধীনতা যুদ্ধে জিয়াউর রহমান যুদ্ধের পরিক্লপনা ও তার বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেন। ১৯৭১ এর জুন পর্যন্ত ১ নং সেক্টর কমান্ডার ও তারপর জেড-ফোর্সের প্রধান হিসেবে তিনি যুদ্ধে অংশগ্রহন করেন। অসীম সাহসিকতা ও জীবনের ঝুঁকি নিয়েই জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। স্বাধীনতার ঘোষণা থেকে শুরু করে প্রতিটি পর্বে তিনি ছিলেন নির্ভীক। যখন রাজনৈতিক নেতারা সিদ্ধান্তহীনতায় ছিলেন, তখন সেনাবাহিনীর একজন মেজর এসে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন; জীবনবাজি রেখে সশস্ত্র যুদ্ধ করেন। সেক্টর কমান্ডার হিসেবে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন; বীর উত্তম খেতাব পান। স্বাধীনতার পর তিনি ফের সৈনিক জীবনে ফিরে যান। সেনাবাহিনীতে সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন।
স্বাধীনতার পর প্রথমে তিনি কুমিল্লা ব্রিগেড কমান্ডার এবং ১৯৭২ সালের জুন মাসে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ডেপুটি চীফ-অফ-স্টাফ নিযুক্ত হন। ১৯৭২ সালে কর্নেল, ১৯৭৩-এর মাঝামাঝি ব্রিগেডিয়ার এবং শেষ দিকে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি লাভ করেন।
স্বাধীনতার ঘোষক, মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার ও জেড ফোর্সের প্রধান হিসেবে জিয়াউর রহমান এ দেশের মানুষের কাছে প্রথম পরিচিত হলেও পরে তিনি বাংলাদেশের একজন বরেণ্য রাষ্ট্রনায়কে পরিণত হন। যুদ্ধবিধ্বস্থ দেশকে রাজনৈতিক ঐকতানে নিয়ে আসা ও সুদৃঢ় অর্থনৈতিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করানোর কারণে তিনি আধুনিক বাংলাদেশের স্থপতি হিসেবে আখ্যা পান। তিনি বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের আদর্শের ভিত্তিতে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গঠনের মধ্যদিয়ে দেশে উন্নয়ন ও উৎপাদনের রাজনীতির সূচনা করেন। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের নতুন দর্শন উপস্থাপন করেন জিয়াউর রহমান। তিনি ১৯ দফা কর্মসূচি দিয়ে দেশে উন্নয়ন ও উৎপাদনের রাজনীতি এগিয়ে নিয়ে যান।
শুধু রাজনীতিবিদরাই নন, জিয়াউর রহমানও বালাদেশের স্বাধীনতার জন্য সেই তরুণ বয়স থেকেই নিজেকে মানসিকভাবে প্রস্তত রেখেছিলেন। এ প্রসঙ্গে তিনি ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের প্রথম স্বাধীনতা দিবসে “একটি জাতির জন্ম“ শিরোনামে নিবন্ধে জিয়াউর রহমান লিখেছেন ..“স্কুল জীবন থেকেই পাকিস্তানীদের দৃষ্টিভঙ্গির অস্বচ্ছতা আমার মনকে পীড়া দিতো। আমি জানতাম, অন্তর দিয়ে ওরা আমাদের ঘৃণা করে।—বাঙালিদের বিরুদ্ধে একটা ঘৃণার বীজ উপ্ত করে দেওয়া হতো স্কুল ছাত্রদের শিশু মনেই।—সেই স্কুল জীবন থেকে মনে মনে আমার একটা আকাংখাই লালিত হতো, যদি কখনো দিন আসে, তাহলে এই পাকিস্তানবাদের অস্তিত্বেই আমি আঘাত হানবো..পাকিস্তানী পশুদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরার, দুর্বারতম আকাংখা দুর্বার হয়ে উঠতো মাঝে মাঝেই। উদগ্র কামনা জাগতো পাকিস্তানের ভিত্তি ভূমিটাকে তছনছ করে দিতে। কিন্তু উপযুক্ত সময় আর উপযুক্ত স্থানের অপেক্ষায় দমন করতাম সেই আকাংখাকে ”।
তার প্রতিষ্ঠিত বিএনপি দেশের মানুষের প্রিয় দল হিসেবে ’৭৯ সালের দ্বিতীয় সংসদ, ’৯১ সালের পঞ্চম সংসদ ও ষষ্ঠ এবং অষ্টম সংসদ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে।
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের অধীনে অনুষ্ঠিত ’৮৬ সালের তৃতীয় ও ’৮৮ সালের চতুর্থ এবং এছাড়া সর্বশেষ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি ক্ষমতাসীন মহাজোটের অধীনে অনুষ্ঠিত একতরফার দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে বিএনপিসহ দেশের অধিকাংশ দল। এই নির্বাচনে ১৫৩টি আসনে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বীই ছিল না। বাকি ১৪৭ আসনের নির্বাচনে সর্বোচ্চ ৫ থেকে ১০ শতাংশ ভোটার উপস্থিতি ছিল বলে বিভিন্ন সংগঠন দাবি করে। নির্দলীয় সরকারের দাবিতে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটসহ অন্যান্য বিরোধী দলও এই নির্বাচন বর্জন করে। একতরফার এই নির্বাচনে সমর্থন জানায়নি দেশী-বিদেশী কোনো সংস্থাই। ভোটারবিহীন সেই নির্বাচনের পর থেকেই বিরোধী জোট দ্রুত সবার অংশগ্রহণে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করে আসছে।
সংবিধান অনুযায়ী দলটি এখনও দেশের প্রধান বিরোধী দল। আগামী ২৪ জানুয়ারি নবম সংসদের মেয়াদ শেষ হবে। যদিও এরই মধ্যে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য রওশন এরশাদকে বিরোধী দলীয় নেতা করে গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে।
৭১ সালে জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা যেমন এ দেশের মুক্তিকামী মানুষকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে সাহস ও প্রেরণা জুগিয়েছিল, তেমনি ’৭৫ সালে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব যখন হুমকির মুখে, তখন সিপাহি-জনতার অভ্যূত্থান হয়। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে আসীন হন। তিনি একদলীয় বাকশালের পরিবর্তে দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। পররাষ্ট্রনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন এনে জিয়াউর রহমান চীনসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রের সঙ্গে নতুন সম্পর্কের সূচনা করেন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাতটি দেশকে নিয়ে ‘সার্ক’ গঠনের উদ্যোগ তারই। ওআইসিকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহর সংহতি জোরদার করার জন্য তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। জিয়াউর রহমান প্রতিষ্ঠিত বিএনপি সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বৃহৎ রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৮১ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে মর্মান্তিকভাবে শাহাদাতবরণ করেন। মুক্তিযুদ্ধে সাহসী অবদানের জন্য স্বাধীনতার পর তৎকালীন সরকার তাকে বীরউত্তম খেতাবে ভূষিত করে।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বর্তমান পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। শহীদ জিয়ার জন্মদিন আজ এমন এক সময়ে উদযাপিত হতে যাচ্ছে, যখন তাঁর প্রতিষ্ঠিত দেশের বৃহত্তম ও জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল বিএনপি পার করছে একটি চরম ও কঠিন সময়। শহীদ জিয়ার সহধর্মিনী, বাংলাদেশের তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া গুলশানে নিজ অফিসে আজ ১৬ দিন ধরে অবরুদ্ধ।
রাষ্ট্রের যথোপযুক্ত দর্শন ও নেতৃত্বের অনুপস্থিতি আজ স্পষ্ট। নেতৃত্ব ক্ষমতাকেন্দ্রিকতার নেশায় ডুবে আছে, যা জাতিকে বারবার সঙ্কটের মুখোমুখি করছে। নির্দ্বিধায় বলা যায়, দেশ ও মানুষকে নিয়ে জিয়াউর রহমান যেভাবে ভেবেছেন, কাজ করেছেন, রাষ্ট্রের দার্শনিক ভিত্তি তৈরি করেছেন, সবকিছুর ঊর্ধ্বে দেশকে গুরুত্ব দিয়েছেন—এসবের মাধ্যমে তিনি এক ব্যতিক্রমী রাষ্ট্রনায়কের আসনে বসেছেন। তিনি দেশ গড়ার ভিশনকে ক্ষমতা ও সময়ের মাপকাঠির বাইরে রেখেছিলেন। রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ভিত্তি মূলত জিয়াউর রহমানই গড়ে তুলেছেন। এজন্য একদিকে ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’ ও অন্যদিকে ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব’ নীতিতে কাজ করেছেন।
বহুদলীয় গনতন্ত্রের প্রবর্তক শহীদ জিয়া ছিলেন বাংলার আকাশের সবচেয়ে উজ্জল নক্ষত্র।স্বাধীনতা উত্তর দুর্ভিক্ষ পিড়িত জনগন শেখ মুজিবের মৃত্যুর পর যখন শুধু অনিষচয়তা আর হতাশা ছাড়া আর কিছুই চোখে দেখছিলনা , ঠিক তখনই জিয়া জালিয়েছিলেন আশার আলো, বাংলাদেশের জনগন বুকে বেধেছিল অনেক বড় স্বপ্ন। কিন্তু দেশ বিরোধী ঘাতক চক্র ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা “র ” এর সহযোগীতায় নির্মম ভাবে শহীদ করে প্রেসিডেন্টকে। তার শাহাদাতে জাতি কলংকিত। সেদিনই আমরা সেই কলংক থেকে মুক্ত হতে পারব যেদিন আমরা গড়তে পারব জিয়ার স্বপ্নের সেই সোনার বাংলাদেশ।
আবার পঁচাত্তরের এক কালো সময়ে জিয়াউর রহমান সামনে চলে আসেন। সময় তাকে জাতীয় ভূমিকায় টেনে আনে। সেটাও ছিল এক অন্ধাকারাচ্ছন্ন সময়। সশস্ত্র বাহিনীর একটি অংশের বিদ্রোহে এবং আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি খন্দকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বে এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় তত্কালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হন। জাতি এক চরম সঙ্কটের মুখোমুখি হয়। এমন এক দিকনির্দেশনাহীন সময়ে সেনা কর্মকর্তা জিয়াউর রহমান জাতীয় ভূমিকায় আবির্ভূত হন। সেখানেও তিনি নানা প্রতিকূলতার মুখে পড়েছেন। কিন্তু দূরদর্শিতা, দেশপ্রেম ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞা তাকে সফলতার শীর্ষে নিয়ে গেছে।
সিপাহী-জনতার বিপ্লব বাংলাদেশের ইতিহাসে এক ঐতিহাসিক ঘটনা। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে ‘জাতীয় ঐক্যের প্রতীক’-এর মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করে সিপাহী-জনতা। ঐক্যবদ্ধ বিপ্লবের মাধ্যমে এ দেশের রাজনীতির গতিপথ নতুন করে নির্মাণ করে। তত্কালীন সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য রাতের আঁধারে বিদ্রোহ করে। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ নিজেকে সেনাপ্রধান হিসেবে ঘোষণা দিয়ে ৩ নভেম্বর সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে বন্দী করেন। ওইদিন জাতীয় চার নেতাকেও জেলখানায় নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাককে পদচ্যুত করে বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব দেয়া হয়। ৩ নভেম্বর জিয়াউর রহমান বন্দী হওয়ার পর ৭ নভেম্বর পর্যন্ত এ চারদিন দেশ ও দেশের জনগণ দুঃসহ পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে অতিক্রম করে। ৬ নভেম্বর রাত প্রায় ১টার সময় সশস্ত্র বাহিনীর পুনরুত্থানবাদী চক্রের বিরুদ্ধে বীর জনগণ, সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনীর সিপাহীরা বিপ্লব ঘটিয়ে বন্দী মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করেন। সিপাহী ও জনতার মিলিত বিপ্লবে চার দিনের দুঃস্বপ্নের ইতি হয়। আওয়াজ ওঠে ‘সিপাহী-জনতা ভাই ভাই’, ‘জিয়াউর রহমান জিন্দাবাদ’। ৭ নভেম্বর সিপাহী বিপ্লবের ফলে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব নিরাপদ হয়।
জিয়াউর রহমান আবার সেনাবাহিনীপ্রধানের দায়িত্ব নেন। এরপর তিনি সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার যেমন উদ্যোগ নেন, তেমনি সময়ের প্রয়োজেন তিনি দেশ গঠনে আত্মনিয়োগ করেন। রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্ম, সমাজনীতি, নৈতিকতা, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক—সব ক্ষেত্রেই তিনি সফলতার স্বাক্ষর রাখেন। রাজনীতিতে অস্থিরতা কাটিয়ে একটি সমন্বিত সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। সামরিক ব্যক্তি হয়েও তিনি রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছিলেন। সাধারণত মিলিটারি শাসকরা রাজনীতিকদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করেন এবং সূক্ষ্ম রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে সামরিক সিদ্ধান্ত প্রয়োগের চেষ্টা করেন। কিন্তু জিয়াউর রহমান রাজনীতি ও সমরনীতির প্রভেদ বুঝতেন। দেশের একটি অন্ধকার সময়ে সেনাপ্রধানের দায়িত্ব পেয়ে ১৯৭৫ সালের ২৩ নভেম্বর জাতির উদ্দেশে দেয়া দ্বিতীয় ভাষণেই জেনারেল জিয়াউর রহমান অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করেন।
৭৫ পরবর্তী ঘটনাবলীকে অন্ধকারাচ্ছন্ন রাখতে এক শ্রনীর বুদ্ধিজীবী ও আওয়মী লীগ এই সময়ের দাবীতে প্রতিষ্ঠিত দলটিকে নিয়ে নানা ধরনের অপপ্রচারে লিপ্ত এবং এই জন্য ঐ সময়কার ঘটনাবলীর কিছু বিষয় তুলে ধরা হলোঃ
শেখ মুজিবকে হত্যার পর বাকশাল নেতা মোশতাক রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ নেন। গঠন করেন মন্ত্রীসভা। শেখ মুজিবের মন্ত্রীসভার প্রায় সকলেই মোশতাকের মন্ত্রীসভার সভায় শপথ নেন। মোশতাক সারাদেশে সামরিক আইন জারি করেন। ঐ সময় সেনাপ্রধান ছিলেন শফিউল্লাহ। শহীদ জিয়া সেই সময় ছিলেন সেনাবাহিনীর ডেপুটি চিফ অফ স্টাফ। শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ডের পরে মোশতাকের মন্ত্রীসভার শপথ অনুষ্ঠানে যাননি জিয়াউর রহমান। বিজয়ীর বেশে গিয়েছিল তাহের-ইনু বাহিনী এবং তৎকালীন মুজিব বিরোধী নেতারা। শেখ মুজিব হত্যাকান্ডের পর আরো কমপক্ষে দশ দিন, অর্থাৎ ২৪শে আগস্ট পর্যন্ত জেনারেল শফিউল্লাহ ছিলেন সেনা প্রধান। রাষ্ট্রদূত হিসাবে সরকারি চাকুরী কনফার্ম করার পর সেনাপ্রধানের পদ ছাড়েন শফিউল্লাহ। এরপর যথা নিয়মে ডেপুটি চীফ অব স্টাফ থেকে প্রমোশন পেয়ে ২৫শে আগস্ট সেনাপ্রধান হন জিয়াউর রহমান। সেনাপ্রধান হিসাবে দায়িত্ব নেয়ার পর রক্ষী বাহিনীর প্রভাবমুক্ত একটি শক্তিশালী পেশাদার ও সেনাবাহিনী গড়ে তোলার কাজ শুরু করেন শহীদ জিয়া। জিয়াকে মেনে নিতে পারেননি ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশারফ। তিনি ভেতরে ভেতরে জিয়াউর রহমানকে সরানোর চক্রান্ত শুরু করেন। চক্রান্তের অংশ হিসেবে খালেদ মোশারফ ১৯৭৫ সালের ২রা নভেম্বর সেনা প্রধান জিয়াউর রহমানকে ক্যান্টনমেন্টে বন্দী করেন। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশারফ ১৯৭৫ সালের ৩রা নভেম্বর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মোশতাকের অনুমোদন নিয়ে মেজর জেনারেল হিসেবে নিজেই নিজের প্রমোশন নেন এবং এরপর প্রশাসন চলে খালেদ মোশারফের ইশারায়। ১৯৭৫ সালের ৫ই নভেম্বর রাষ্ট্রপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেন মোশতাক। তার আগে মোশতাক এবং খালেদ মোশারফ বিচারপতি সায়েমকে রাষ্ট্রপতি হিসাবে দায়িত্ব দেন ৬ই নভেম্বর। বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম প্রধান বিচারপতি। শেখ মুজিব পাকিস্তানী পাসপোর্ট নিয়ে বাংলাদেশে ফেরত আসেন ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারী। এর দুই দিন পর ১২ই জানুয়ারী সায়েমকে প্রধান বিচারপতি হিসাবে নিয়োগ দেয়া হয়। ১৫ই আগস্ট থেকে মোশতাক-শফিউল্লাহর জারী করা সামরিক আইন বহাল থাকায় রাষ্ট্রপতি সায়েম একাধারে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের ও দায়িত্ব পালন করেন। উল্লেখ্য, ৭ই নভেম্বর সংঘটিত হয় সিপাহী-জনতার ঐতিহাসিক বিপ্লব। শহীদ জিয়াকে বের করে আনা হয় বন্দীদশা থেকে। ১৯৭৫ সালের ৩রা নভেম্বর জেলের মধ্যে সংঘটিত হয় ৪ নেতা হত্যাকান্ড।আবার ৬ই নভেম্বর পাল্টা ক্যু’তে নিহত হন খালেদ মোশারফ। ১৯৭৭ সালের ২০শে এপ্রিল পর্যন্ত রাষ্ট্রপ্রতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন বিচারপতি সায়েম। এ সময়কালে জিয়া ছিলেন সেনা প্রধান এবং উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক। ১৯৭৭ সালের ২০শে এপ্রিল প্রেসিডেন্ট পদ থেকে পদত্যাগ করেন বিচারপ্রতি সায়েম। এরপর প্রেসিডেন্ট এবং উত্তরাধিকারী হিসেবে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দাযিত্ব নেন শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান।
১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি গঠিত বাকশালের মাধ্যমে হত্যা করা গণতন্ত্রকে পুনর্জীবন দেন জিয়াউর রহমান। এমনকি বাকশালের মাধ্যমে বিলুপ্ত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকেও পুনর্জন্ম দেন বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা জিয়াউর রহমান। বাকশালী একদলীয় শাসন অবসান হওয়ার পর দেশে যে রাজনৈতিক শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছিল তা পূরণ করতে বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র পূনঃপ্রবর্তন এবং এর ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে বিএনপি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।সব রাজনৈতিক দলকে মুক্তভাবে রাজনীতি করার সুযোগ করে দেন। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের পাহারাদার হিসেবে নিজে প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি। জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক আদর্শের এই দলের নেতৃত্বে তিনি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ভিত্তি রচনা করেন। সবাইকে নিয়ে তিনি একটি আত্মনির্ভরশীল সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে উদ্যোগী হন। তার এ কর্মপ্রচেষ্টা বিশ্বব্যাপী সমাদৃত হয়। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হাতে গড়া বিএনপি বিগত ৩৭ বছরে বার বার জনগণের ভোটে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে এবং দেশ ও জনগণের সমৃদ্ধি ও কল্যাণে কাজ করে গেছে।
রাষ্ট্রীয় দায়িত্বভার গ্রহণ
২১ এপ্রিল ১৯৭৭ প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম ভগ্নস্বাস্থ্যের কারণে দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ান এবং সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে প্রেসিডেন্ট পদে মনোনীত করেন। জিয়াউর রহমান বঙ্গভবনে অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন। ৩০ এপ্রিল ১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমান ১৯ দফা কর্মসূচি শুরু করেন।
২ মে এক ঘোষণায় প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ৩০ মে ’৭৭ গণভোট হয় তার ওপর ও তার নীতির ওপর এবং তার কর্মসূচির প্রতি ভোটারদের আস্থা আছে কি না সেজন্য।
গণভোটে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের প্রতি জনগণের আস্থা
৩০ মে ’৭৭ অনুষ্ঠিত গণভোটে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এবং তার ১৯ দফা কর্মসূচি ও নীতির প্রতি দেশবাসী বিপুল আস্থা জ্ঞাপন করেন। ১২ হাজার ২৬৪টি কেন্দ্রের ভোটের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, মোট ভোটের সংখ্যা ১ কোটি ৯২ লাখ ৯ হাজার ৬০টি। এর মধ্যে ১ কোটি ৮৯ লাখ ৯৩ হাজার ৯২টি ‘হ্যাঁ’ সূচক ভোটের সংখ্যা। ‘না’ সূচক ভোটের সংখ্যা ২ লাখ ১৫ হাজার ৯৬৮টি। সকল ক্ষমতার উত্স জনগণ তাদের আস্থার রায় জানিয়েছেন স্বাধীনতা যুদ্ধের বীর সৈনিক এবং নবীন প্রত্যাশায় উদ্দীপ্ত বাংলাদেশের স্বর্ণালি অভিজ্ঞতার নায়ক মেজর জেনারেল জিয়াকে, জনগণ তাদের রায় দিয়েছেন স্বাধীনভাবে।
জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল) গঠন
১৯৭৮ সালের ২২ ফেবু্রয়ারি জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল) সরকারি অনুমোদন পায়। রাজনৈতিক দলবিধি (পিপিআর) ১৯৭৮ মোতাবেক এ নয়া দলের অনুমোদনের কথা ঢাকা পৌরসভা চেয়ারম্যান আবুল হাসনাতকে চিঠির মাধ্যমে ২২ ফেবু্রয়ারি জানানো হয়।
বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে আহ্বায়ক করে জাগদলের ১৬ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি ২২ ফেব্রুয়ারি ঘোষণা করা হয়। আহ্বায়ক কমিটির সদস্যরা ছিলেন— প্রফেসর সৈয়দ আলী আহসান, আবদুল মোমেন খান, শামসুল আলম চৌধুরী, ক্যাপ্টেন (অব.) নুরুল হক, এনায়েতউল্লাহ খান, মওদুদ আহমদ, জাকারিয়া চৌধুরী, ড. এম আর খান, সাইফুর রহমান, জামাল উদ্দিন আহমদ, আবুল হাসনাত, এম এ হক, ক্যাপ্টেন (অব.) সুজাত আলী, আলহাজ এম এ সরকার ও আবুল কাশেম।
২৭ মার্চ ১৯৭৮ জাগদল প্রথম তাদের ম্যানিফেস্টো ঘোষণা করে। পর্যায়ক্রমে সারাদেশে জাগদলের কমিটি গঠন করা হয়। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ২৯ মার্চ এক ভাষণে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, ‘ডিসেম্বরে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।’
১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের দ্বিবার্ষিক পরিকল্পনা ঘোষণা করেন। ঘোষণার আগে তিনি বলেন, পরিকল্পনাটির সাফল্য প্রধানত নির্ভর করে কৃষি উন্নয়ন ও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ওপর। আর এজন্য জাতিকে রাজনৈতিক লক্ষ্য স্থির করে দেশের সমস্যা সমাধানে আত্মনিয়োগ করতে হবে।
জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক দলে যোগদান
৯ এপ্রিল ১৯৭৮ জিয়াউর রহমান প্রথম আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন, তিনি রাজনৈতিক দলে যোগদান করবেন এবং ডিসেম্বরের নির্বাচনে প্রার্থী হবেন। ১৯৭৮ সালের ২ মে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে চেয়ারম্যান করে ৬টি দলের সমন্বয়ে ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট’ গঠন করা হয়। যে সব রাজনৈতিক দল ফ্রন্ট গঠন করে, সেগুলো হলো— জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল), ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ভাসানী), ইউনাইটেড পিপলস পার্টি, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, বাংলাদেশ লেবার পার্টি ও বাংলাদেশ তফসিলি জাতীয় ফেডারেশন। জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টের ৬টি অঙ্গ দলের এক বৈঠকে আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে জিয়াউর রহমানকে মনোনয়ন দেয়া হয়।
১৯৭৮ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন
দেশে গণতান্ত্রিক ধারা ফিরিয়ে আনার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনী অনুচ্ছেদ নং ১১৮ থেকে ১২৬ অনুযায়ী ১৯৭৮ সালের ৩ জুন প্রাপ্তবয়স্কদের প্রত্যক্ষ সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ১৯৭৮ সালে অনুষ্ঠিত এ নির্বাচন অতীব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সাক্ষ্য বহন করছে। এতে বহুদলীয় রাজনীতির ভিত্তিতেই রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং প্রায় সব রাজনৈতিক দলই এ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। রাষ্ট্রপতি পদের জন্য মোট ১০ জন প্রার্থী পূর্ণপ্রস্তুতি নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তার মধ্যে জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টের মনোনীত প্রার্থী ছিলেন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। অন্যদিকে তার অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন গণতান্ত্রিক ঐক্যজোটের মনোনীত প্রার্থী জেনারেল (অব.) এম এ জি ওসমানী। আওয়ামী লীগ, জাতীয় জনতা পার্টি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মোজাফ্ফর), পিপলস পার্টি, গণআজাদী লীগ ও নিষিদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের সমন্বয়ে গণতান্ত্রিক ঐক্যজোট গঠিত হয়েছিল। অন্যদের মধ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং নির্দলীয় প্রার্থী ছিলেন।
নির্বাচনে জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট প্রার্থী জিয়াউর রহমান ১ কোটিরও বেশি ভোটের ব্যবধানে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ঐক্যজোট প্রার্থী জেনারেল (অব.) এম এ জি ওসমানীকে পরাজিত করে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। এ নির্বাচনে মোট ৫৩ দশমিক ৫৪ ভাগ ভোটার ভোট প্রদান করেন। এর মধ্যে ৭৩ দশমিক ৬৩ ভাগ ভোট পান জিয়াউর রহমান। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী এম এ জি ওসমানী পান ২১ দশমিক ৭০ ভাগ ভোট।
১৯৭৮ সালের ১২ জুন জিয়াউর রহমান বঙ্গভবনের দরবার হলে এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। স্বাধীন বাংলাদেশে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত প্রথম রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। এর আগের সব রাষ্ট্রপতি সময়ের প্রয়োজনে কিংবা জবরদস্তি করে রাষ্ট্রপতির পদে দায়িত্ব নিয়েছিলেন। এজন্যই জনগণের ভোটে প্রথম নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান গণমানুষের হৃদয়ে নিজের স্থান করে নেন।
১৯৭৮ সালের ২৯ জুন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান উপদেষ্টা পরিষদ ভেঙে দিয়ে ২৮ সদস্যের একটি মন্ত্রিপরিষদ গঠন করেন। বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব দেন। মন্ত্রিপরিষদের সিনিয়র মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন মশিউর রহমান যাদু মিয়া। মন্ত্রিপরিষদের অন্য সদস্যরা হলেন— ড. মির্জা নুরুল হুদা, শাহ আজিজুর রহমান, কাজী আনোয়ারুল হক, অধ্যাপক মোহাম্মদ শামসুল হক, আজিজুল হক, এসএম শফিউল আজম, আবদুল মোমেন খান, মেজর জেনারেল (অব.) মাজেদুল হক, ক্যাপ্টেন (অব.) আবদুল হালিম চৌধুরী, বি এম আব্বাস, লে. কর্নেল (অব.) আবু সালেহ মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান, রসরাজ মণ্ডল, মোহাম্মদ সাইফুর রহমান, জামাল উদ্দিন আহমেদ, ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, কাজী জাফর আহমদ, শামসুল হুদা চৌধুরী, ক্যাপ্টেন (অব.) নুরুল হক, এ জেড এম এনায়েতউল্লাহ খান, মওদুদ আহমদ, এস এ বারী এটি, ড. মিসেস আমিনা রহমান, মির্জা গোলাম হাফিজ, কে এম ওবায়দুর রহমান, আবদুল আলীম, হাবিবুল্লাহ খান ও আবদুর রহমান। প্রতিমন্ত্রী হন দু’জন ডা. ফসিউদ্দীন মাহতাব ও ডা. এম এ মতিন।
এই মন্ত্রিপরিষদেও প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বহুদলীয় গণতন্ত্রের ধারণা বাস্তবায়ন করেন। মন্ত্রিপরিষদে ২৮ জন মন্ত্রীর মধ্যে ১৮ জন ছিলেন জাগদলের, ৪ জন ন্যাপ ভাসানীর, ২ জন ইউপিপির ও ১ জন তফসিলি ফেডারেশনের। বিশেষত ৪ জন ছিলেন সাবেক সামরিক অফিসার, ৮ জন বেসামরিক অফিসার, ১ জন সাংবাদিক ও বাকিরা হলেন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ।
জাতীয় দায়িত্ব প্রাপ্তির অল্প সময়ের মধ্যেই সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান নিজের আন্তরিকতা, কর্ম ও চেষ্টা দিয়ে দেশবাসীর হৃদয়ে জায়গা করে নেন। সামাজিক বিশৃঙ্খলা প্রতিরোধে তিনি রাজনৈতিক নেতৃত্বকে দল-মতের ঊর্ধ্বে উঠে এক প্লাটফর্মে আনার উদ্যোগ নেন। দেশ পরিচালনায় তাদের পরামর্শকে প্রাধান্য দেয়া হয়। তাঁর এই ইতিবাচক উদ্যোগের বিরুদ্ধেও দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র অব্যাহত থাকে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তিনি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পান। এই দায়িত্ব পেয়ে প্রথমেই তিনি বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের উদ্যোগ নেন। গণমাধ্যমের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেন। জনগণের প্রতিনিধির হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা দিতে তিনি প্রেসিডেন্ট পদে গণভোট এবং সাধারণ নির্বাচন দেন। গণতান্ত্রিক উপায়ে জাতির ব্যাপক সমর্থন পেয়ে জিয়াউর রহমান গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনেন।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি প্রতিষ্ঠা
জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টের শরিক দলগুলোর সমন্বয়ে ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল’ নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগ নেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান।জাতীয় সংসদ নির্বাচন এগিয়ে আসলে জিয়া বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল গঠন করেন। এ পরিস্থিতিতে ২৮ আগস্ট বিচারপতি আবদুস সাত্তার এক জরুরি আদেশে জাগদল ও এর সব অঙ্গদলকে বিলুপ্ত ঘোষণা করেন। এখানে উল্লেখ্য, বিএনপি গঠন করার আগে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল) নামে আরেকটি দল তৎকালীন উপ-রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে সভাপতি করে গঠিত হয়েছিল। ২৮ আগস্ট ১৯৭৮ সালে নতুন দল গঠন করার লহ্ম্য জাগদলের বর্ধিত সভায় ওই দলটি বিলুপ্ত ঘোষণার মাধ্যমে দলের এবং এর অঙ্গ সংগঠনের সকল সদস্য জিয়াউর রহমান ঘোষিত নতুন দলে যোগদানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ।
১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর বিকাল ৫টায় রমনা রেস্তোরাঁয় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের প্রতিষ্ঠাতা তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এক সংবাদ সম্মেলনে আনুষ্ঠানিক ঘোষণাপত্র পাঠের মাধ্যমে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের যাত্রা শুরু করেন। জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে তিনি ঘোষণাপত্র পাঠ ছাড়াও প্রায় দুই ঘণ্টা সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন।
সংবাদ সম্মেলনে জিয়াউর রহমান ঘোষিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের ঘোষণাপত্রে বলা হয় : বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে ইস্পাতকঠিন গণঐক্য, জনগণভিত্তিক গণতন্ত্র ও রাজনীতি প্রতিষ্ঠা, ঐক্যবদ্ধ ও সুসংগঠিত জনগণের অক্লান্ত প্রয়াসের মাধ্যমে জাতীয় অর্থনৈতিক মুক্তি, আত্মনির্ভরশীলতা ও প্রগতি অর্জন এবং সাম্রাজ্যবাদ, সম্প্রসারণবাদ, নয়া উপনিবেশবাদ ও আধিপত্যবাদের বিভীষিকা থেকে মুক্তি নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল’ গঠিত হয়েছে। এই চারটি লক্ষ্যকে ‘জনগণের মৌলিক দাবি’ বলে ঘোষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলকে জাতীয় মিলন ও ঐক্যের দল হিসেবে উল্লেখ করে দলের ঘোষণাপত্রে বলা হয়, এই দলের বৈপ্লবিক উদারতা ও বিশালতা সব দেশপ্রেমিক মানুষকে এক অটল ঐক্যবাদী কাতারে শামিল করতে সক্ষম হবে। সক্ষম হবে জাতীয় পর্যায়ে স্থিতিশীলতা, সার্বিক উন্নতি ও প্রগতি আনয়ন করতে।
ঘোষণাপত্রে স্থিতিশীল গণতন্ত্রের রূপরেখায় প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির সরকার নির্বাচিত ও সার্বভৌম পার্লামেন্টের প্রতি দলের আস্থা জ্ঞাপন করা হয়। এতে দেশের শতকরা ৯০ জন অধিবাসী মধ্যবিত্ত গ্রামের সার্বিক উন্নয়নের প্রতি সকল পর্যায়ে অগ্রাধিকার দেয়া হয়। ভূমি ব্যবস্থা ও প্রশাসনকে ন্যায়বিচারভিত্তিক, আধুনিক ও সুবিন্যস্ত করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়। গণমুখী কৃষিনীতি ও কার্যক্রম প্রণয়ন, সমবায়ের ভিত্তিতে জাতীয় উন্নয়ন, সৃজনশীল উত্পাদনমুখী ও গণতান্ত্রিক শ্রমনীতি প্রণয়ন, গণমুখী জীবননির্ভর কার্যক্রম প্রণয়ন, জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতাকে সুনিশ্চিত করতে দেশরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার, মুক্তিযোদ্ধাদের সৃজনশীল, গঠনমূলক ও উত্পাদনমূলক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ, বাংলাভাষা ও সাহিত্যের সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও প্রসার, শাসনতন্ত্রের জীবননির্ভর ও বাস্তবমুখী রূপ সংরক্ষণ ও স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি নিশ্চিতকরণ, সামাজিক ও বৈষম্য দূরীকরণ, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার সুদৃঢ় অঙ্গীকার করা হয় ঘোষণাপত্রে।
জাগদলকে বিএনপির সাথে একীভূত করা হয়। রাষ্ট্রপতি জিয়া এই দলের সমন্বয়ক ছিলেন এবং এই দলের প্রথম চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। অধ্যাপক একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী এর প্রথম মহাসচিব ছিলেন। জিয়ার এই দলে বাম, ডান, মধ্যপন্থি সকল প্রকার লোক ছিলেন। বিএনপির সবচেয়ে প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল এর নিয়োগ পদ্ধতি। প্রায় ৪৫ শতাংশ সদস্য শুধুমাত্র রাজনীতিতে যে নতুন ছিলেন তাই নয়, তারা ছিলেন তরুণ।
সংবাদ সম্মেলনে নতুন দলের আহ্বায়ক কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি প্রথমে ১৮ জন সদস্যের নাম এবং ১৯ সেপ্টেম্বর ওই ১৮ জনসহ ৭৬ সদস্য বিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করেন। নিচে দলের প্রথম আহ্বায়ক কমিটির পূর্ণাঙ্গ তালিকা দেয়া হলো :
আহ্বায়ক : জিয়াউর রহমান।
সদস্য : ১. বিচারপতি আবদুস সাত্তার
২. মশিউর রহমান যাদু মিয়া
৩. মোহাম্মদ উল্লাহ
৪. শাহ আজিজুর রহমান
৫. ক্যাপ্টেন (অব.) আবদুল হালিম চৌধুরী
৬. রসরাজ মন্ডল
৭. আবদুল মোনেম খান
৮. জামাল উদ্দিন আহমেদ
৯. ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী
১০. মির্জা গোলাম হাফিজ
১১. ক্যাপ্টেন (অব.) নুরুল হক
১২. এম. সাইফুর রহমান
১৩. ওবায়দুর রহমান
১৪. মওদুদ আহমদ
১৫. শামসুল হুদা চৌধুরী
১৬. এ জেড এম এনায়েতউল্লাহ খান
১৭. এসএ বারী এটি
১৮. ড. আমিনা রহমান
১৯. আবদুর রহমান
২০. ডা. এম এ মতিন
২১. আবদুল আলিম
২২. ব্যারিস্টার আবুল হাসনাত
২৩. আনোয়ার হোসেন মঞ্জু
২৪. নুর মোহাম্মদ খান
২৫. আবদুল করিম
২৬. শামসুল বারী
২৭. মুজিবুর রহমান
২৮. ডা. ফরিদুল হুদা
২৯. শেখ আলী আশরাফ
৩০. আবদুর রহমান বিশ্বাস
৩১. ব্যারিস্টার আবদুল হক
৩২. ইমরান আলী সরকার
৩৩. দেওয়ান সিরাজুল হক
৩৪. এমদাদুর রহমান
৩৫. এডভোকেট আফসার উদ্দিন
৩৬. কবীর চৌধুরী
৩৭. ড. এম আর খান
৩৮. ক্যাপ্টেন (অব.) সুজাত আলী
৩৯. তুষার কান্তি বারবি
৪০. সুনীল গুপ্ত
৪১. রেজাউল বারী ডিনা
৪২. আনিসুর রহমান
৪৩. আবুল কাশেম
৪৪. মনসুর আলী সরকার
৪৫. আবদুল হামিদ চৌধুরী
৪৬. মনসুর আলী
৪৭. শামসুল হক
৪৮. খন্দকার আবদুল হামিদ
৪৯. জুলমত আলী খান
৫০. এডভোকেট নাজমুল হুদা
৫১. মাহবুব আহমেদ
৫২. আবু সাঈদ খান
৫৩. মোহাম্মদ ইসমাইল
৫৪. সিরাজুল হক মন্টু
৫৫. শাহ বদরুল হক
৫৬. আবদুর রউফ
৫৭. মোরাদুজ্জামান
৫৮. জহিরুদ্দিন খান
৫৯. সুলতান আহমেদ চৌধুরী
৬০. শামসুল হুদা
৬১. সালেহ আহমেদ চৌধুরী
৬২. আফসার আহমেদ সিদ্দিকী
৬৩. তরিকুল ইসলাম
৬৪. আনোয়ারুল হক চৌধুরী
৬৫. মাইনুদ্দিন আহমেদ
৬৬. এমএ সাত্তার
৬৭. হাজী জালাল
৬৮. আহমদ আলী মন্ডল
৬৯. শাহেদ আলী
৭০. আবদুল ওয়াদুদ
৭১. শাহ আবদুল হালিম
৭২. ব্যারিস্টার মুহাম্মদ জমিরুদ্দিন সরকার
৭৩. আতাউদ্দিন খান
৭৪. আবদুর রাজ্জাক চৌধুরী
৭৫. আহমদ আলী।
মূলনীতি
বিএনপির লক্ষ্য ছিল অর্থনৈতিক উন্নয়ন, গণতন্ত্রায়ন, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে জাতীয় ঐক্য এবং জনগণের মধ্যে স্ব-নির্ভরতার উত্থান ঘটানো। এগুলোর ভিত্তিতে জিয়াউর রহমান তার ১৯-দফা ঘোষণা করেন। বিএনপির রাজনীতির মূল ভিত্তি ছিল-
১. সর্বশক্তিমান আল্লাহ্র উপর বিশ্বাস,
২. জাতীয়তাবাদ,
৩. গণতন্ত্র,
৪. সমাজতন্ত্র (অর্থনৈতিক ও সমাজিক ন্যায়বিচারের অর্থে)।
দলীয় স্লোগান
“ শহীদ জিয়া অমর হউক।
বাংলাদেশ জিন্দাবাদ।
উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য:
জাতীয়তাবাদী দলের ঘোষণাপত্রে এ দলের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বিস্তৃতভাবে বর্ণিত হয়েছে। সংক্ষেপে এ দলের কয়েকটি মৌলিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বর্ণিত হলোঃ
(ক) বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ-ভিত্তিক ইস্পাতকঠিন গণঐক্যের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা, রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা ও গণতন্ত্র সুরক্ষিত ও সুসংহত করা।
(খ) ঐক্যবদ্ধ এবং পুনরুজ্জীবিত জাতিকে অর্থনৈতিক স্বয়ম্ভরতার মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদ, সম্প্রসারণবাদ, নয়া-উপনিবেশবাদ, আধিপত্যবাদ ও বহিরাক্রমণ থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করা।
(গ) উৎপাদনের রাজনীতি, মুক্তবাজার অর্থনীতি এবং জনগণের গণতন্ত্রের মাধ্যমে সামাজিক ন্যায়বিচারভিত্তিক মানবমুখী অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও জাতীয় সমৃদ্ধি অর্জন।
(ঘ) জাতীয়তাবাদী ঐক্যের ভিত্তিতে গ্রামে-গঞ্জে জনগণকে সচেতন ও সুসংগঠিত করা এবং সার্বিক উন্নয়নমুখী পরিকল্পনা ও প্রকল্প রচনা ও বাস্-বায়নের ক্ষমতা ও দক্ষতা জনগণের হাতে পৌঁছে দেওয়া।
(ঙ) এমন এক সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি করা যেখানে গণতন্ত্রের শিকড় সমাজের মৌলিক স্তরে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মনে দৃঢ়ভাবে প্রোথিত হয়।
(চ) এমন একটি সুস্পষ্ট ও স্থিতিশীল সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার নিশ্চিতি দেওয়া যার মাধ্যমে জনগণ নিজেরাই তাঁদের মানবিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নতি আনতে পারবেন।
(ছ) বহুদলীয় রাজনীতির ভিত্তিতে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত একটি সংসদীয় পদ্ধতির সরকারের মাধ্যমে স্থিতিশীল গণতন্ত্র কায়েম করা এবং সুষম জাতীয় উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি আনয়ন।
(জ) গণতান্ত্রিক জীবন ধারা ও গণতান্ত্রিক বিধি ব্যবস্থার রক্ষাকবচ হিসাবে গণনির্বাচিত জাতীয় সংসদের ভিত্তি দৃঢ়ভাবে স্থাপন করা এবং জনগণের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ করা।
(ঝ) রাজনৈতিক গোপন সংগঠনের তৎপরতা এবং কোন সশস্ত্র ক্যাডার, দল বা এজন্সী গঠনে অস্বীকৃতি জানানো ও তার বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টি করা।
(ঞ) জাতীয় জীবনে মানবমুখী সামাজিক মূল্যবোধের পুনরুজ্জীবন এবং সৃজনশীল উৎপাদনমুখী জীবনবোধ ফিরিয়ে আনা।
(ট) বাস্তবধর্মী কার্যকরী উন্নয়ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জাতীয় জীবনে ন্যায়বিচার-ভিত্তিক সুষম অর্থনীতির প্রতিষ্ঠা, যাতে করে সকল বাংলাদেশী নাগরিক অন্ন, বস্ত্র, স্বাস্থ্য, বাসস্থান ও শিক্ষার ন্যূনতম মানবিক চাহিদা পূরণের সুযোগ পায়।
(ঠ) সার্বিক পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচীকে অগ্রাধিকার দান করা ও সক্রিয় গণচেষ্টার মাধ্যমে গ্রাম বাংলার সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করা।
(ড) নারী সমাজ ও যুব সম্প্রদায়সহ সকল জনসম্পদের সুষ্ঠু ও বাস্-বভিত্তিক সদ্ব্যবহার করা।
(ঢ) বাস্তবধর্মী অর্থনৈতিক পরিকল্পনা গ্রহণ এবং সুসামঞ্জস্যপূর্ণ শ্রম ব্যবস্থাপনা সম্পর্ক স্থাপন এবং সুষ্ঠু শ্রমনীতির মাধ্যমে শিল্পক্ষেত্রে সর্বোচ্চ উৎপাদন নিশ্চিত করা।
(ণ) বাংলা ভাষা ও সাহিত্য, বাংলাদেশের সংস্কৃতি, কৃষ্টি ও বাংলাদেশের ক্রীড়া সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও প্রসার সাধন।
(ত) বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশী জনগণের ধর্ম ইসলাম এবং অন্যান্য ধর্মীয় শিক্ষার সুযোগ দান করে বাংলাদেশের জনগণের যুগপ্রাচীন মানবিক মূল্যবোধ সংরক্ষণ করা, বিষে করে অনগ্রসর সম্প্রদায়ের জন্য শিক্ষা সম্প্রসারণ ও বৃহত্তর জাতীয় তাদের অধিকতর সুবিধা ও অংশগ্রহণের সুযোগের যথাযথ ব্যবস্থা করা।
(থ) পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে জোট নিরপেক্ষতার ভিত্তিতে আন্-র্জাতিক বন্ধুত্ব, প্রীতি ও সমতা রক্ষা করা। সার্বভৌমত্ব ও সমতার ভিত্তিতে প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে, তৃতীয় বিশ্বের মিত্র রাষ্ট্রসমূহের সাথে এবং ভ্রাতৃপ্রতিম মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে প্রীতি ও সখ্যতার সম্পর্ক সুসংহত এবং সুদৃঢ় করা।
সাংগঠনিক কাঠামো
জাতীয়তাবাদী দল দেশের মৌলিক স্তর গ্রাম/ওয়ার্ড পর্যায় থেকে সংগঠিত হয়ে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত সম্প্রসারিত। দলের সাংগঠনিক কাঠামো নিম্নরূপঃ (১) গ্রাম কাউন্সিল ও গ্রাম নির্বাহী কমিটি (২) শহর/পৌরসভা ওয়ার্ড কাউন্সিল ও শহর/পৌরসভা ওয়ার্ড নির্বাহী কমিটি (৩) ইউনিয়ন কাউন্সিল ও ইউনিয়ন নির্বাহী কমিটি (৪) থানা কাউন্সিল ও থানা নির্বাহী কমিটি (৫) শহর/পৌরসভা কাউন্সিল ও শহর পৌরসভা নির্বাহী কমিটি (৬) জেলা কাউন্সিল ও জেলা নির্বাহী কমিটি (৭) নগর/ওয়ার্ড কাউন্সিল ও নগর ওয়ার্ড নির্বাহী কমিটি (৮) নগর থানা কাউন্সিল ও নগর থানা নির্বাহী কমিটি (৯) নগর কাউন্সিল ও নগর নির্বাহী কমিটি (১০) জাতীয় কাউন্সিল (১১) জাতীয় নির্বাহী কমিটি (১২) জাতীয় স্থায়ী কমিটি (১৩) পার্লামেন্টারী বোর্ড (১৪) পার্লামেন্টারী পার্টি (১৫) বিদেশে দলের শাখা
জাতীয় ঐক্য
বিএনপি গঠনের শুরুতে দেশে বিভিন্ন ভাবে বিভক্ত ছিল। এই বিভক্তির ভিত্তি ছিল রাজনৈতিক বিশ্বাস (বাম, ডান, মধ্যপন্থি), মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের ও বিপক্ষের শক্তি ইত্যাদি। এর ফলশ্রুতিতে ছাত্র-শিক্ষক, বুদ্ধজীবী, পেশাজীবি, সাংস্কৃতিক কর্মী, সামরিক বাহিনী এমনকি প্রশাসনও বিভক্ত ছিল। বিএনপি প্রতিষ্ঠার মূল ভিত্তি ছিল এই সকল বিভেদ ভুলে সকলে মিলে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। জিয়ার সময়ই আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা, শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর পর প্রথম দেশে আসেন এবং আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সেই সাথে জামায়াতে ইসলামীও এই সময় রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে উঠে। তাদের বহু নেতা যারা মুক্তিযুদ্ধের পর দেশের বাইরে ছিল তারা দেশে আসার অনুমতি লাভ করে। উল্লেখ্য, মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তি শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতাকারি সকল দল ও ব্যক্তির জন্য ক্ষমা ঘোষণা করেন। তবে, যাদের বিরুদ্ধে সরাসরি হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নি সংযোগ ও লুটপাট এই চারটি অভিযোগ থাকবে তারা এই ক্ষমার আওতায় পরে নাই। যদিও, এদের বিরুদ্ধে তেমন কোন ব্যাপক ও কার্যকরী ব্যবস্থা নেওয়ার উদাহরণ নেই।
পররাষ্ট্রনীতি
শুরু থেকেই বিএনপির লক্ষ্য ছিল জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা। স্বাধীনতা পরবর্তি সরকারের ভারত-ঘেষা পররাষ্ট্রনীতির ফলে বাংলাদেশ আন্তর্জার্তিক অঙ্গনে ভারত-সোভিয়েত অক্ষের দিকে চলে যায়, ফলে বাংলাদেশের অন্যান্য বিশ্বশক্তির সাথে সম্পর্ক তেমন ভাল ছিল না। বিএনপি তার পররাষ্ট্রনীতিতে নিরপেক্ষতা ধারণ করে।
১৯৭৯ সালের সংসদ নির্বাচন ও বিএনপির সরকার গঠন
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সর্বতোভাবে চেষ্টা করেছিলেন দেশে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও সরকার প্রতিষ্ঠার। ১৯৭৮ সালের ৩০ নভেম্বর এক ঘোষণায় প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য ১৯৭৯ সালের ২৭ জানুয়ারি তারিখ নির্ধারণ করেন। এ নির্বাচনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণের প্রস্তুতি নেয় এবং তাদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া ও শর্ত পূরণের জন্য নির্বাচন দু’দফায় পেছানো হয়। ১৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে ৩০০টি আসনের মধ্যে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ২০৭টি আসন পেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। ৩৯টি আসন পেয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ (মালেক) প্রধান বিরোধী দলের মর্যাদা পায়। এছাড়া বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ (মিজান) ২টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) ৮টি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মোজাফ্ফর) ১টি, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ ও ইসলামী ডেমোক্রেটিক দল ২০টি, গণফ্রন্ট ২টি, বাংলাদেশ জাতীয় লীগ ২টি, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক আন্দোলন ১টি, বাংলাদেশ সাম্যবাদী দল (তোয়াহা) ১টি এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ১৬টি আসন পায়।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সাবেক প্রেসিডেন্ট, স্বাধীন বাংলার রূপকার, বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তক শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান শুধু একটি নাম নয়, তিনি একটি ইতিহাসও বটে। সেদিন বিভক্ত বাঙালী জাতি তার ডাকে এক কাতারে শামিল হয়ে দেশ গড়ার কাজে অংশ নিয়েছিল। তার কাছে ছিলনা কোন ভেদাভেদ। সকলের মাঝে সাম্যের রাজনৈতিক চিন্তাধারা প্রতিষ্টার জনক শহীদ জিয়া। এ কারণে তিনি মরেও অমর হয়ে আছেন।শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নাম বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার ও জেড ফোর্সের অধিনায়ক ছিলেন।
দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ। একজন ঈমানদার মানুষের মধ্যে দেশপ্রেম থাকা অপরিহার্য। দেশপ্রেম ও সততা শব্দ দুটি একে অন্যের পরিপূরক। যে দেশপ্রেমিক সে অবশ্যই সত্। আবার যে ব্যক্তি সত্ তার মধ্যে অবশ্যই দেশপ্রেম আছে। একজন প্রকৃত নেতার মধ্যে অনেক গুণাবলী থাকা আবশ্যক। তার মধ্যে দেশপ্রেম ও সততা অন্যতম। সততা ও দেশপ্রেমের কারণেই শহীদ জিয়া আমাদের প্রিয় নেতা ও জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব। আমাদের বিশ্বাস, জিয়াউর রহমানের যে কট্টর সমালোচক, সেও জিয়াউর রহমানের সততা ও দেশপ্রেম নিয়ে কটূক্তি করতে পারবে না। সততা ও দেশপ্রেমের প্রশ্নে আপসহীন এই মহান নেতা দেশের কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় অবস্থান করে নিয়েছেন।
মুহাম্মদ মনসুর রহমান ও জাহানারা খাতুনের দ্বিতীয় পুত্র শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দে ১৯ জানুয়ারী বগুড়া জেলার বাগাবাড়ী গ্রামে তাঁর পিতামহের বসত বাড়ীতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর শিশুকাল এবং শৈশবের প্রথম অধ্যায় কেটেছে এই বাগাবাড়ি গ্রামেই।
মানুষের জীবনের সমচেয়ে গুরুত্বপূর্ন সময় হলো তার শিশুকাল বা ছেলেবেলা। কারন এই সময়টা হলো নিজেকে আবিস্কার করার এবং প্রকৃতির ভেতর নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার সময়। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও এর ব্যতিক্রম নন।
শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ডাকনাম ছিল কমল। কমল অর্থ পদ্ম। পিতা মুহাম্মদ মনসুর রহমান এবং মাতা জাহানারা খাতুনের বড় আদরের সন্তান ছিলেন এই কমল। তাঁরা হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন, তাঁদের এই সন্তান পদ্মের মতো বিকশিত হয়ে উঠবে আপন গুন, গরিমা ও প্রতিভায়। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান অসম্ভাবিতভাবে তাঁর পিতা মুহাম্মদ মনসুর রহমান এবং মাতা জাহানারা খাতুনের নিবিড় পরিচর্যায় বড় হয়ে উঠলেও তার সাথে তাঁর পিতামহ মৌলভী কামাল উদ্দিন মন্ডল এবং তাঁর মাতামহী রহিমা খাতুনের প্রত্যক্ষ প্রভাব শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের উপর লক্ষ্য করা যায়। আর তাঁর মাতামহ আবুল কাশেম আহম্মেদ এবং তাঁর পিতামহী মিসির উন্নিসা বেগম এবং তাঁর চাচা ডা: মমতাজুর রহমানের পরোক্ষ প্রভাবও তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে দেখা যায়।
ধার্মিক এবং ব্যাক্তিত্ববান পিতামহ মৌলভী কামাল উদ্দিনের সাহচার্যে কাটে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মধুর শিশুকাল। দ্বিতীয়ত তাঁর মাতামহী রহিমা খাতুনের প্রভাব ও শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের উপর প্রভাব বিস্তার করেছিল। কারন তিনি বহু বিরল গুনের অধিকারিনী ছিলেন। তিনি ছিলেন তেহস্বিনী মহিলা, সংগীত চর্চা করতেন। শিক্ষা এবং সাহিত্যের প্রতি তাঁর ছিল বিশেষ আগ্রহ এবং অনুরাগ। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মাতা জাহানারা খাতুনের সংগীত গুরু ছিলেন শহীদ জিয়ার মাতামহী।
শহীদ জিয়া গভীর আগ্রহ নিয়ে সারাদিন পরিশ্রম করে ক্লান্ত হয়ে বাড়ী ফিরলেও খাওয়া দাওয়ার পর বিছনায় যেয়ে এই সংগীতের প্রতি অনুরক্ত হতে ভুলতেন না। সেই ছোট বেলা থেকে শুরু করে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের এই অভ্যাস বিদ্যমান ছিল।
ছোটবেলায় শহীদ জিয়া খুব খেলাধুলা করতেন। ফুটবল, হকি ও ক্রিকেট ছিলো শহীদ জিয়ার প্রিয় খেলা। মাঝেমধ্যে গুলি, ডান্ডাও খেলতেন। আবার কখনো কখনো বৃষ্টিতে ভিজতেন কাঁদা মেখে আনন্দ পেতেন। কখনো কখনো আকাশে ঘুড়ি উড়াতেন। খেলাধুলায় মেতে থাকলেও সন্ধ্যায় রাস্তায় বাতি জ্বলে ওঠার সাথে সাথে বাড়ী ফিরে যেতেন শহীদ জিয়া। এরপর লেখা পড়ায় মনোনিবেশ করতেন তিনি। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে যাওয়া শহীদ জিয়ার ছোট বেলা অভ্যাস ছিল। স্বল্পভাষী হলেও ছেলেবেলায় ও শহীদ জিয়া ছিলেন প্রানবন্ত।
চকলেট তাঁর খুব প্রিয় ছিল ছোট বেলায়। পছন্দ করতেন মিষ্টি ও মুরগির গোশত। বিশেষ করে মুরগির পাখনাকে শহীদ জিয়া শিশু কালে নাম দিয়েছিলেন লাঙল। আর প্রিয় খাবার ছিল ভাজা বাসী ভাত বগুড়ার আঞ্চলিক ভাষায় যাকে বলা হয় ‘কড়কড়া’।
শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের বয়স যখন ৪ বৎসর তখন থেকে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে স্কুলে যাতায়াত শুরু করেন। এই সালটি ছিল ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দ। কারন শহীদ জিয়ার পিতামহ মৌলভী কামাল উদ্দিন মন্ডল স্কুলে অর্থাৎ যে স্কুলে শহীদ জিয়ার হাতে খঁড়ি সেই বাগাবাড়ি মাইনর স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। শহীদ জিয়ার হাতে খড়ি হয় তারই পিতামহের হাতে। বাগাবাড়িতে তিনি ছিলেন ছোট কমলের প্রথম শিক্ষা গুরু।
সেই সূত্রে জিয়াউর রহমানের সৌভাগ্য যে তিনি তার পিতামহের কাছ থেকে জীবনের বিভিন্ন বিষয় ও বস্তুনিষ্ট মূল্যায়ন করতে শিখেছিলেন। এরপর ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর পিতা মুহাম্মদ মনসুর রহমান তাঁর পরিবারকে কোলকাতায় নিয়ে যান। তখন শহীদ জিয়ার বয়স ৬ বছর। তাঁকে ভর্তি করা হয় পার্ক সার্কাসের আমীন আলী এভিনিউতে অবস্থিত শিশু বিদ্যাপীঠে।
এক বছর এই স্কুলে তিনি পড়াশুনা করার পর আবার নিজ গ্রাম বগুড়ার বাগবাড়িতে ফিরে যায় তার পরিবার। বগুড়ার বাগবাড়ী গ্রামে পিতামহের বসত বাড়ীতে শহীদ জিয়ার আর একটি বছর কাটে। আবার বাগবাড়ি মাইনর স্কুলে এক বছররের জন্যে ভর্তি হন শহীদ জিয়া।
এরপর শহীদ জিয়ার পরিবার আবার কলকাতায় ফিরে আসেন। শুরু হয় নতুন উদ্দীপনায় আবার এক নতুন জীবন চলা। সালটি ছিল ১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দ। শহীদ জিয়াকে তখন কলকাতায় কলেজ স্ট্রীটের হেয়ার স্কুলে তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি করে দেওয়া হয়। সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত শহীদ জিয়া হেয়ার স্কুলেই লেখাপড়া করেন।
১৯৪৭ এর দেশ বিভাগের পর শহীদ জিয়ার পিতা মো: মনসুর রহমানের সরকারী চাকরী সূত্রে পরিবার পরিজন নিয়ে পাকিস্তানের করাচীতে চলে আসেন। শহীদ জিয়াকে ১৯৪৮ এর ১ জুলাই ভর্তি করে দেয়া হয় করাচী একাডেমী স্কুলে সপ্তম শ্রেনীতে। বর্তমানে সেই স্কুলের নাম তাইয়ের আলী আলভী একাডেমী। ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান যোগদান করেন পাকিস্তান সামরিক একাডেমীতে একজন অফিসার ক্যাডেট হিসেবে। শুরু হয় তার জীবন সংগ্রামের নতুন অধ্যায়।
জীবনের শুরু থেকেই একটি নৈতিক একটি আদার্শিক কঠিন বাতাবরন চিন্তা ও দর্শনের উপর টিকে থাকার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে জীবন শুরু শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত— সেই জীবন দর্শন থেকে একটি মুহূর্তের জন্যও বিচ্যুত হননি তিনি।
১৯৫২ সালে তিনি দ্বিতীয় বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন করাচিতে ‘করাচি একাডেমি স্কুল’ (বর্তমানে, তাইয়েব আলী আলভী একাডেমী) থেকে। ম্যাট্রিক পাসের পর তিনি ভর্তি হন করাচির ‘ডি জে কলেজে’। ১৯৫৩ সালে ‘পাকিস্তান সামরিক একাডেমি’তে একজন অফিসার ক্যাডেট হিসেবে যোগ দেন।
১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে একজন কোম্পানি কমান্ডার হিসেবে বীরত্ব দেখিয়ে জিয়াউর রহমান পাক সেনাবাহিনীতে প্রভাবশালী কর্মকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হন। এ সময়েই জিয়াউর রহমান বাঙালি সহকর্মীদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা করেন। এরপর তাকে পাকিস্তান সামরিক একাডেমীতে প্রশিক্ষকের দায়িত্ব দেয়া হয়। সেখানেও তিনি নবীন সেনা অফিসারদের সঙ্গে ‘স্বাধীন বাংলাদেশ’ বিষয়ে কথা বলেছেন।
এদিকে, ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর পূর্ব-পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে ক্ষমতা প্রাপ্তির সুযোগ পায় পূর্ব-পাকিস্তান আওয়ামী লীগ। জাতীয় পরিষদের ১৬২ আসনের মধ্যে ১৬০টি ও প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৮৮টি আসনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে।
এই বিশাল বিজয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে পূর্ব-পাকিস্তান আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান রাষ্ট্রের ক্ষমতা গ্রহণের অপেক্ষায় ছিলেন। অন্যদিকে, পাকিস্তান পিপলস্ পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো এ নির্বাচনে অপেক্ষাকৃত কম আসনে জয় পেয়েও ক্ষমতা ভাগাভাগির নানা কৌশল আটতে থাকেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানও এ অপকৌশলে সহায়ক ভূমিকা রাখেন। দীর্ঘ বিলম্বের পর ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। কিন্তু, কোনো কারণ ছাড়াই হঠাত্ ১ মার্চ দুপুরে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন তিনি।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ফুঁসে ওঠে পূর্ব-পাকিস্তানের জনগণ। ১ মার্চ থেকেই রাজপথে নেমে আসেন তারা। ২ মার্চ উত্তাল হয়ে ওঠে ঢাকা। শাসকগোষ্ঠীর কারফিউ ভেঙে দিন-রাত চলে বিক্ষোভ। বিক্ষোভে নির্বিচারে গুলিতে নিহত হয় অন্তত তিনজন। আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান এদিন এক বিবৃতিতে ৩ মার্চ থেকে ৬ মার্চ প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত গোটা প্রদেশে হরতালের ডাক দেন।
২ মার্চ থেকে ৫ মার্চ দেশজুড়ে সংঘর্ষ চলে। বহু মানুষ হতাহত হন। ৬ মার্চ দুপুর ১টা ৫ মিনিটে রেডিও পাকিস্তানের জাতীয় অনুষ্ঠানে ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন এবং ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের উদ্বোধনী অধিবেশন আহ্বান করেন।
পরের দিন ঐতিহাসিক ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবুর রহমান কী ভাষণ দেবেন তা শোনার জন্য সারাদেশ ও আন্তর্জাতিক মহল অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল। ৭ মার্চ শেখ মুজিব বজ্রকণ্ঠে সাত দফা ঘোষণা করেন। সামরিক আইন ও সেনা বাহিনী প্রত্যাহার, গণহত্যার তদন্ত এবং জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, জনগণের প্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করা হইলে পরিষদের অধিবেশনে যোগদানের প্রশ্ন বিবেচনা করা যাইতে পারে, তাহার পূর্বে নয়।’ সাবেক প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমানের লেখা ‘বাংলাদেশের তারিখ’ (প্রথম সংস্করণ) নামক গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে—“বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘জয়-বাংলা, জয় পাকিস্তান’ বলে ৭ মার্চের ভাষণ শেষ করেন।”
৯ মার্চ মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী পল্টনের এক জনসভায় শেখ মুজিবকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী অপেক্ষা বাংলার নায়ক হওয়া অনেক গৌরবের।’ (দৈনিক আজাদ, ১০ মার্চ ১৯৭১) ১০ মার্চ একইভাবে তিনি বলেন, ‘আলোচনায় কিছু হবে না। ওদের আসসালামু আলাইকুম জানিয়ে দাও।’
১৩ মার্চ ভৈরবে এক জনসভায় ভাসানী বলেন, ‘পূর্ববাংলা এখন সম্পূর্ণ স্বাধীন এবং আমরা এখন একটি পূর্ববাংলা সরকারের অপেক্ষায় আছি।’ ১৪ মার্চ জনতার বাঁধভাঙা আন্দোলনের একপর্যায়ে শেখ মুজিবুর রহমান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির প্রধান ওয়ালী খানের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক শেষে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠকের আগ্রহ প্রকাশ করেন।
শাসনতান্ত্রিক সংকট প্রশ্নে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলোচনার জন্য ১৫ মার্চ প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও প্রেসিডেন্ট জেনারেল আবু মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান ঢাকায় আসেন। ১৬ মার্চ প্রথম শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান বৈঠকে বসেন।
১৭ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের দ্বিতীয় দফা সংলাপও সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ হয়। ১৮ মার্চ মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠকের বিরতি ছিল। ১৯ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের মধ্যে তৃতীয় দফা বৈঠক হয়। বৈঠকের পর শেখ মুজিব সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি মঙ্গলের প্রত্যাশী, আবার চরম পরিণতির জন্যও প্রস্তুত।’ ২০ মার্চ বৈঠকের পর আলোচনায় কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে বলে জানান তিনি।
২১ মার্চ পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো ঢাকায় আসেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পৃথকভাবে শেখ মুজিবুর রহমান ও ভুট্টোর সঙ্গে বৈঠক করেন। রাজনৈতিক সঙ্কট উত্তরণে ২২ মার্চ মুজিব-ইয়াহিয়া-ভুট্টো শীর্ষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এরপর পূর্ব ঘোষিত ২৫ মার্চের জাতীয় পরিষদের সভা স্থগিত করা হয়।
দীর্ঘ আলোচনার পর ২৪ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সমঝোতার আভাস দেন। সংবাদ সম্মেলনে শেখ মুজিব বলেন, ‘ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে আমরা মতৈক্যে পৌঁছেছি। আমি আশা করি, প্রেসিডেন্ট এখন তা ঘোষণা করবেন।’
২৫ মার্চ দিনব্যাপী ঢাকা শহরে চলে প্রতিবাদ মিছিল, রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড সৃষ্টি এবং বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষ চলে সংগ্রামী মানুষের সঙ্গে সেনাবাহিনীর জওয়ানদের। সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান গোপনে ঢাকা ত্যাগ করেন। এ দিন রাত ১১টার পর থেকে অপারেশন সার্চ লাইট শুরু করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। পাকবাহিনী রাজারবাগ পুলিশ লাইন, পিলখানা, ইপিআর সদর দফতর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ পুরো ঢাকা মহানগরীতে হত্যাযজ্ঞ চালায় এবং অগ্নিসংযোগ করে।
রাত ১টা ১০ মিনিটের দিকে একটি ট্যাংক, একটি সাঁজোয়া গাড়ি এবং কয়েকটি ট্রাক বোঝাই সৈন্য শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ির ওপর দিয়ে গুলি ছুড়তে ছুড়তে রাস্তা ধরে এগিয়ে আসে এবং তাকে সহ ৪ জন চাকর এবং একজন দেহরক্ষীকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের আগেই শেখ মুজিবুর রহমান গণহত্যার প্রতিবাদ এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবিতে ২৭ মার্চ সারাদেশে হরতাল আহ্বান করেন। পরের দিন শেখ মুজিবের গ্রেফতার ও হরতালের খবর প্রায় সব পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
এদিকে রাত আনুমানিক ২টা ১৫ মিনিটের দিকে চট্টগ্রাম থেকে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন মেজর জিয়াউর রহমান। এর আগে দিনে চট্টগ্রাম শহরে টানটান উত্তেজনা বিরাজ করে। অস্ত্র বোঝাই জাহাজ সোয়াতের বিরুদ্ধে গড়ে তোলা হয় প্রবল প্রতিরোধ। অস্ত্র খালাস করে যাতে পশ্চিমা সৈন্যদের হাতে না পৌঁছতে পারে সে জন্য রাস্তায় রাস্তায় তৈরি করা হয় ব্যারিকেড। এই ব্যারিকেড সরিয়ে রাস্তা পরিষ্কারের কাজে লাগানো হয় বাঙালি সৈন্যদের। রাত ১০টা পর্যন্ত চলে এই ব্যারিকেড সরানোর কাজ। রাত ১১টায় চট্টগ্রামস্থ অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট’র কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল আবদুর রশীদ জানজুয়া আকস্মিকভাবে সেকেন্ড ইন কমান্ড মেজর জিয়াউর রহমানের কাছে নির্দেশ পাঠান এক কোম্পানি সৈন্য নিয়ে বন্দরে যাওয়ার জন্য।
রাত প্রায় সাড়ে ১১টায় জানজুয়া নিজে এসে মেজর জিয়াকে নৌ-বাহিনীর একটি ট্রাকে তুলে ষোলশহর ক্যান্টনমেন্ট থেকে বন্দরের দিকে রওনা করিয়ে দেন। সঙ্গে একজন নৌ বাহিনীর অফিসারকে (পশ্চিম পাকিস্তানি) গার্ড হিসেবে দেয়া হয়। রাস্তায় বিভিন্ন জায়গায় ব্যারিকেড সরিয়ে যেতে তাঁর দেরি হয়। আগ্রাবাদে একটা বড় ব্যারিকেডের সামনে বাধা পেয়ে তাঁর ট্রাক থেমে যায়, তখনই পেছন থেকে একটি ডজ গাড়িতে ছুটে আসেন ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান। গাড়ি থেকে নেমেই তিনি দৌড়ে যান মেজর জিয়াউর রহমানের কাছে। হাত ধরে তাকে রাস্তার ধারে নিয়ে যান। জানান, ক্যাপ্টেন অলি আহমদের কাছ থেকে বার্তা নিয়ে এসেছেন। পশ্চিমারা গোলাগুলি শুরু করেছে। শহরে বহু লোক হতাহত হয়েছে। এতে চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন মেজর জিয়াউর রহমান। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে দৃঢ়কণ্ঠে তিনি বলে ওঠেন— ‘উই রিভোল্ট।’ সঙ্গে সঙ্গে তিনি খালেকুজ্জামানকে ষোলশহরে ফিরে গিয়ে ব্যাটালিয়নকে তৈরি করার জন্য কর্নেল অলি আহমদকে নির্দেশ দিতে বলেন। আর সেই সঙ্গে নির্দেশ পাঠান ব্যাটেলিয়নের সমস্ত পশ্চিমা অফিসারকে গ্রেফতারের। এই রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল জানজুয়াসহ সব পশ্চিমা অফিসারকে গ্রেফতার করা হলো।
এরপর অন্যান্য ব্যাটেলিয়নের বাঙালি সেনা কর্মকর্তাদের ফোন করলেন, কিন্তু অনেককেই পেলেন না। এ পর্যায়ে তিনি বেসামরিক বিভাগে টেলিফোন অপারেটরকে ফোন করে ডিসি, এসপি, কমিশনার, ডিআইজি ও আওয়ামী লীগ নেতাদের জানাতে অনুরোধ করেন যে, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অষ্টম ব্যাটালিয়ন বিদ্রোহ করেছে। টেলিফোন অপারেটর মেজর জিয়ার এ অনুরোধ সানন্দে গ্রহণ করেন।
এ পরিস্থিতিতে মেজর জিয়া অষ্টম ব্যাটেলিয়নের অফিসার, জেসিও জোয়ানদের জড়ো করলেন। ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে তখন রাত আনুমানিক ২টা ১৫ মিনিট। তিনি ঐতিহাসিক স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন। ঘোষণায় বললেন, “আমি মেজর জিয়াউর রহমান প্রভিশনাল প্রেসিডেন্ট ও লিবারেশন আর্মি চিফ হিসেবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি এবং যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য দেশবাসীকে আহ্বান জানাচ্ছি। বাংলাদেশ স্বাধীন। আমরা স্বাধীনতা যুদ্ধে অবতীর্ণ হলাম। আপনারা যে যা পারেন, সামর্থ্য অনুযায়ী অস্ত্র নিয়ে বেরিয়ে পড়ুন। আমাদেরকে লড়াই করতে হবে এবং পাকিস্তানি বাহিনীকে দেশ ছাড়া করতে হবে।”
মেজর জিয়া ২৬ মার্চ সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রে যান। বেতার কর্মীরা মেজর জিয়াউর রহমানকে পেয়ে উত্ফুল্ল হয়ে ওঠেন। কিন্তু কি বলবেন তিনি? একটি করে বিবৃতি লেখেন আবার তা ছিঁড়ে ফেলেন। এদিকে বেতার কর্মীরা বারবার ঘোষণা করছিলেন যে, আর পনের মিনিটের মধ্যে মেজর জিয়াউর রহমান ভাষণ দেবেন। প্রায় দেড় ঘণ্টায় তিনি তৈরি করেন তাঁর ঐতিহাসিক ঘোষণাটি। সেটা তিনি বাংলা এবং ইংরেজিতে পাঠ করেন। এই ঘোষণা ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ দিল্লির ‘দি স্টেটস্ম্যান’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
আমাদের দেশে বহুল প্রচারিত একটি বিতর্ক আছে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা কে করেছেন ? দেশে বড় দুটি দল , একটি বিএনপি অপরটি মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বাধীন দল আওয়ামী লীগ । তাদের প্রত্যেকের দাবি তাদের নেতার পক্ষে । এমন একটি বিষয় যা স্বাধীনতার বিশেষ একটি মান মর্যাদার সাথে জড়িত, এমন একটি বিষয় নিয়ে বিতর্ক করা কখনই উচিত নয় । কিন্তু আমাদের দেশে অনুচিত অনেক কিছু ঘটে যা বিশ্বে আর কোন দেশে ঘটে না । যেমন, স্বাধীনতার মহান নেতাকে গালি দেয়া , দেশ নিয়ে বিতর্ক করা , ইত্যাদি .।এর সাথে স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে এই বিতর্ক কোন নূতন ঘটনা নয় । তবে আমাদের এই বিতর্কের ফলে জাতি দিন দিন পিছিয়ে পড়ছে । এই পিছিয়ে পড়া জাতি কি করে মাথা তুলে দাঁড়াবে যদি কোন একতা না থাকে ?
জিয়াউর রহমান ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন এনিয়ে কোনো বিতর্কের কোন সুযোগ নেই। জিয়াউর রহমান সেদিন সাত কোটি বাঙালির স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। বাংলাদেশের স্বাধীণতার ঘোষনা তৎক্ষালীন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ দেওয়ার কথা থাকলেও তা দিতে তারা ব্যর্থ হয়েছিলেন। এ জন্য ২৬ মার্চ জিয়াউর রহমান এই ঘোষনা দিয়ে জাতিকে মুক্তি সংগ্রামের দিকে দাবিত করেছিলেন। এই ঘোষনা কারো প্রেরিত বার্তা ছিলোনা বরং জিয়াউর রহমানের নিজের লিখা বার্তা ছিলো।
জিয়াউর রহমান রণাঙ্গনে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন এবং জেড ফোর্সের প্রধান হিসেবে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। ১৯৭১-এর ২৬ মার্চ থেকে দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হয় মহান বিজয়। বিশ্ব মানচিত্রে ঠাঁই করে নেয় বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্র। বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমান ব্যারাকে ফিরে যান এবং সেনাবাহিনীর নিয়মিত চাকরিতে যোগ দেন। তাঁর ডাকে দেশের সর্বস্তরের মানুষ স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিয়ে দেশ স্বাধীন করেন। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী যদি যুদ্ধে জয়লাভ করত তাহলে জিয়াউর রহমানকে ফাঁসিতে ঝুলতে হতো।
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতারের পরমুহুর্তে মেজর জিয়ার দুঃসাহসিক আত্মপ্রকাশ। মেজর জিয়াই মরহুম রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করে নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করে শেখ মুজিবকে ইতিহাসের মহানায়ক হওয়ার ক্ষেত্র টেকসই করে সম্প্রসারিত করেছেন। আজকাল স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে বিতর্ক নিরর্থক এবং নিতান্তই কূট রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের হাতিয়ার মাত্র। মেজর জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণা আছে বিশ্বজুড়ে।
ততকালীন মেজর জিয়া পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পক্ষ ত্যাগ করে একাত্তরের ২৬ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ নিজ কানে শুনেছেন জিয়ার কন্ঠে ঘোষিত স্বাধীনতার বাণী। শুধু বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নয় বর্হিবিশ্বের গোয়েন্দা নেটওয়ার্কেও জিয়াউর রহমানের দেয়া স্বাধীনতার ঘোষণা ধরা পড়ে। আর সেভাবেই সন্নিবেশিত হয় তাদের নথিতে। অবমুক্তকৃত সিআই এর গোপন দলিলে সেই সত্যটিই প্রকাশ পেয়েছে মাত্র। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার, ভারতের প্রেসিডেন্ট মোরারজী দেশাইও জিয়াউর রহমানকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক বলে উল্লেখ করেছেন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ফোরামে এবং বিভিন্ন সময় উচ্চারিত হয়েছে এ প্রসঙ্গটি। জিয়াউর রহমান একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা লগ্নে চট্টগ্রামের কালুর ঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে ২৬ মার্চ নিজ দায়িত্বে এবং ২৭ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার কথা ১৯৮২ সালে নভেম্বর মাসে প্রথম প্রকাশিত স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্রের ১৫ খন্ডে উল্লেখ রয়েছে। জিয়ার কণ্ঠে স্বাধীনতার অমোঘ ঘোষণা সিআইএর মত লন্ডনের সাপ্তাহিক গার্ডিয়ান সহ গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা ও সংবাদ মাধ্যম লিপিবদ্ধ করে রেখেছে।জিয়ার তেজোদীপ্ত কন্ঠের ঘোষণা শুনেছেন এমন লক্ষ লক্ষ মানুষ এখনো বাংলাদেশের মুক্ত বাতাসে নি:শ্বাস ফেলছেন। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেনানায়ক ও আওয়ামী লীগ নেতা জেনারেল কেএম শফিউল্লাহ, মেজর রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম, সৈয়দ আলী আহসান, ব্যারিষ্টার আমিরুল ইসলাম, আনিসুজ্জামান, রাও ফরমান আলী, মেজর জেনারেল সুখবন্ত সিং, মেজর জেনারেল লছমন সিং, লে. জেনারেল মতিন, জেনারেল সুবিদ আলী ভূঁইয়াসহ অনেকেই তাদের নিজগৃহে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে জিয়ার কন্ঠে স্বাধীনতা ঘোষণা প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন। জিয়া একাত্তরের ২৬ মার্চ সন্ধ্যা ৭:৪৫ মিনিটে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে প্রথম স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙ্গররত অবস্থায় একটি জাপানী জাহাজ থেকে অষ্ট্রেলিয়া রেডিওতে জিয়ার ঘোষণার বার্তাটি পাঠানো হয়। অস্ট্রেলিয়া রেডিও জিয়ার ঘোষণাটি প্রথম প্রচার করে। এরপর বিবিসি’তে প্রচারিত হওয়ার পর তা পর্যায়ক্রমে ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে।
জিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণার প্রমাণ মিলে ভারতের ততকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বক্তব্যেও। ১৯৭১ সালের ৬ নভেম্বর নিউইয়র্কের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিনারে বক্তৃতায় এক জায়গায় ইন্দিরা গান্ধী বলেন, শেখ মুজিব এখনো বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেননি। তিনি চাচ্ছেন সমস্যার একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান, যার সুযোগ এখনো আছে। ‘ইন্ডিয়া সিকস’ (ওহফরধ ঝববশং) নামক বইতে ইন্দিরা গান্ধীর এ বক্তব্যটি সংকলিত হয়েছে।১৯৭৮ সালে ভারত সফরকালে দিল্লিতে জিয়াউর রহমানের সম্মানে আয়োজিত ভোজ সভায় ভারতের ততকালীন প্রেসিডেন্ট নীলম সঞ্জীব রেড্ডি জিয়াকে বলেন, সর্বপ্রথম স্বাধীনতা ঘোষণা করে আপনি বাংলাদেশের ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন। প্রয়াত ঔপন্যাসিক হুমায়ুন আহমেদ তার “জোসনা ও জননীর গল্প” উপন্যাসের (১৮২-১৮৩) পাতায় জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণার বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে লিখেছেন।এরকম অনেক উদাহরণ ও প্রমাণ রয়েছে দেশে বিদেশে বইপুস্তকে-দলিল দস্তাবেজে, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিদের উক্তিতে। একাত্তরে ২৬ মার্চ শেখ মুজিব গ্রেফতার হন পাকবাহিনীর হাতে। এমতাবস্থায় তার পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার মতো সুযোগ ও সময় কোনটাই ছিলো না। সেদিন শেখ মুজিবের কন্ঠের স্বাধীনতা ঘোষণার কথা কেউ শুনেননি। তাতে কিবা আসে যায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রাপ্তিতে শেখ মুজিবের ভূমিকা ও অবদান অবিস্মরণীয়। স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে না পারার কারণে তার মর্যাদা বিন্দুমাত্র ম্লান হওয়ার কোন অবকাশ নেই।
অথচ এমন একটি স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত সত্যকে মিথ্যে প্রমাণিত করার যারপরনাই চেষ্টা চলছে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে । দেশের আপামর জনসাধারণের আস্থা ও বিশ্বাসের মূলে কুঠারাঘাত করে কোর্ট-কাচারী, মামলা-মোকদ্দমা এমনকি রাষ্ট্রীয় সংবিধান পাল্টিয়ে জিয়াউর রহমানকে তার প্রাপ্য মূল্যায়ন ও মর্যাদা থেকে বঞ্চিত করার অপচেষ্টায় রত বর্তমান সরকার। বিকৃত করা হচ্ছে ইতিহাস। প্রতিহিংসার করাত চালিয়ে জাতিকে চিড়ে ফেলার চেষ্টা কখনো শুভ হতে পারে না। ইতিহাসে যার যেখানে স্থান সেখানে অবশ্যই তাকে সমাসীন করতে হবে। কাউকে অবমূল্যায়ন, অবমাননা করে কিংবা একজনের জায়গায় অন্যকে প্রতিস্থাপিত করে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। অসুস্থ রাজনীতির বহমান এ ধারা দেশ ও জাতিকে কোথায় নিয়ে ঠেকাবে সে আশংকাই আজ বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। এ বিভেদ বিভ্রান্তি ও প্রতিহিংসার রাজনীতি থেকে বেড়িয়ে আসতে হলে জাতীয় নেতৃবৃন্দকে তাদের নিজ নিজ মর্যাদার আসনে বসাতে হবে।
জিয়া ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সিপাহশালার। তিনি ছিলেন, এগার হাজার প্রতিরোধকারী সেনার কমান্ডার। সেটাই ১০ এপ্রিল ১৯৭১ সালে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পরবর্তীতে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ জাতির উদ্দেশে একটি বক্তব্য দেন, যেটি প্রচারিত হয় ১১ এপ্রিল ১৯৭১ স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রে। সেখানে তাজউদ্দীন আহমদ বলেন First announced through Major Ziaur Rahman, to set up a full Fledged operational base from which it is administering the liberated areas. (Bangladesh Documents, Vol-I, Indian Government, page 284).
বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ (মরহুম) অলি আহাদ তার “জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৭-৭৫” বইয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে লেখেন, “…আমি জনাব আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর সহিত নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করিতাম তাহার বাসায় রাত্রিযাপন করিতে গিয়ে তাহারই রেডিও সেটে ২৭ মার্চ চট্টগ্রাম বেতারকেন্দ্র হইতে মেজর জিয়াউর রহমানের কণ্ঠস্বরে স্বাধীন বাংলার ডাক ধ্বনিত হইয়াছিল। এই ডাকের মধ্যে সেই দিশেহারা, হতভম্ব, সম্বিতহারা ও মুক্তিপ্রাণ বাঙালি জনতা শুনিতে পায় এক অভয়বাণী, আত্মমর্যাদা রক্ষার সংগ্রামে ঝাঁপাইয়া পড়িবার আহ্বান, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের লড়াইয়ের সংবাদ।”
ভারতে সরকারী ওয়েব সাইটে বলা আছে “While the where abouts of Mujib remained unknown, Major Ziaur Rahman announced the formation of the provisional government of Bangladesh over radio Chittagong. আর মার্কিন ষ্টেট ডিপার্টমেন্টের বিবৃতি On march 27 the clandestine radio announced the formation of a revolutionary army and provisional government under the leadership of Major Ziaur Rahman”.
মুক্তিযুদ্ধের ৫ নাম্বার সেক্টরের কমান্ডার মেজর মীর শওকত আলী (বীর-উত্তম) লিখেছেন, ” অষ্টম বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডার জিয়াউর রহমান বিদ্রোহ ঘোষণা করলে এবং পরে স্বাধীনতাযুদ্ধের ডাক দিলে আমি সানন্দে যুদ্ধে যোগদান করি। “
আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেজর রফিক-উল ইসলাম (বীর-উত্তম) তার A tale of Millions বইয়ের ১০৫-১০৬ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, “২৭ মার্চের বিকেলে তিনি (মেজর জিয়া) আসেন মদনাঘাটে এবং স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।”
একজন পাকিস্তানী সামরিক কর্মকর্তা হিসেবে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়েছিলেন’ বলে সম্প্রতি দালিলিক সত্য প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ। সংস্থাটির ওয়াশিংটনস্থ সদর দফতর সম্প্রতি বাংলাদেশ বিষয়ক গোপন দলিল অবমুক্ত করলে এ বিষয়ে গত ৯ডিসেম্বর ঢাকায় প্রথম আলো পত্রিকায় সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান এর লেখা একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। ওয়াশিংটন থেকে গত ৮ ডিসেম্বর প্রেরিত নিবন্ধে মিজানুর রহমান খান সিআইএর গোপন দলিলের বরাত দিয়ে লিখেন- ‘সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হলেও জিয়া ছিলেন ক্যারিশমেটিক নেতা । প্রায় ছয় বছরের নেতৃত্বে এক আশাবিহীন দরিদ্র ও বিশৃংখল অবস্থা থেকে তিনি বাংলাদেশকে সমস্যা মোকাবিলা করার উপযোগী করে তুলেছিলেন।’ ১৯৮২ সালের নভেম্বরে প্রস্তুত সিআইএ’র বাংলাদেশ বিষয়ক হ্যান্ডবুকে দেশের প্রথম দশকের রাজনীতি মূল্যায়ন করে বলা হয়, জিয়াউর রহমানের হত্যাকান্ড বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি নতুন অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করে। পর্যাপ্ত সামরিক নেতৃত্বের ঘাটতির সুযোগে সামরিক বাহিনী একটি প্রভাবশালী রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। সিআইএর গোপন দলিলে জিয়াউর রহমানের প্রশংসার পাশাপাশি বলেছে ‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর রাজনীতিকরণকে তিনি আরো বিস্তৃত করেছিলেন।’
শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, যিনি সামরিক বাহিনীর উর্দি ছেড়ে নিজেকে বেসামরিক ব্যক্তিতে পরিণত করেছেন। এর আগেও তিনি আরেকবার উর্দি ছেড়েছিলেন, সেটা ২৬ মার্চ উই রিভোল্ট বলার মাধ্যম। জিয়া সৈনিক ছিলেন আজীবন, যে অর্থে একজন সৈনিক সব সময় যিনি যুদ্ধে থাকেন, থাকেন যুদ্ধক্ষেত্রে। সেই যুদ্ধ পাকিস্তানের দুঃশাসন থেকে অবরুদ্ধ বাংলাদেশকে মুক্ত হাওয়ায় শ্বাস নেওয়ার ব্যবস্থা করে। বাংলাদেশ বুক ভরে শ্বাস নেয়, তারা জানালা খুলে দেয়। বাংলাদেশকে অস্পষ্ট মেরুদ- থেকে একটা শক্ত মেরুদন্ডের ওপর দাঁড় করান তিনি। জিয়া অস্বাভাবিক রাষ্ট্র পাকিস্তান কে যুদ্ধের ময়দানে দাঁড়িয়ে স্বাভাবিক রাষ্ট্র বাংলাদেশের সৃষ্টি করেন। আবার সেই বাংলাদেশে যখন একদলীয় বাকশাল আর রাহুর গ্রাসের মধ্যে পড়ে তখন তাকে মুক্ত করেন।
তিনি ছিলেন বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা, বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রতীক। দেশ, মাটি ও মানুষের জন্যে আমৃত্যু নিবেদিতপ্রাণ এই ব্যক্তিত্বের পরিচিতি সর্বজনবিদিত। দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়ক, অসাধারণ দেশপ্রেমিক, অসম সাহসী ও সহজ-সরল ব্যক্তিত্বের প্রতীক হিসেবে জিয়াউর রহমান ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
২৫ মার্চের কালরাত্রিতে ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ পাকিস্তানী হানাদার
