হ-বাংলা নিউজ:
গত বছরের আগস্টে বাংলাদেশের আটটি জেলায় বন্যার সময় একটি শিশুর সাদা-কালো ছবি—যেখানে সে প্রায় কাঁধসমান পানিতে দাঁড়িয়ে—সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক আলোড়ন তোলে। ছবিটি আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল ও অভিনেত্রী পরীমনি সহ অনেকে শেয়ার করেন।
অনেকেই শিশুটির খোঁজ জানতে চাইলেও পরে জানা যায়, এটি একটি এআই (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) প্রযুক্তি দিয়ে তৈরি করা ছবি—বাস্তব নয়। মানবিক আবেগে নাড়া দেওয়া এই ছবিটি ছিল কেবল ডিজিটাল কল্পনা।
এ ঘটনা কেবল বাংলাদেশের জন্যই নয়, বরং গোটা বিশ্বেই এআই ব্যবহারের সম্ভাবনা ও অপব্যবহারের বাস্তব উদাহরণ। বিশ্বের অনেক দেশ ইতোমধ্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) নিয়ন্ত্রণে আইনি কাঠামো তৈরি করলেও, বাংলাদেশ এখনো পিছিয়ে রয়েছে।
বাংলাদেশে এআই-এর ব্যবহার ও আইনি শূন্যতা
বর্তমানে বাংলাদেশে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য কোনো সুস্পষ্ট আইন, নীতিমালা বা নির্দেশিকা নেই। আইটি বিশেষজ্ঞ ও আইনজীবীদের মতে, এই খাতে এখনো কোনো সমন্বিত প্রস্তুতি নেই।
তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের উপদেষ্টা ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব জানান, সরকার একটি জাতীয় এআই নীতিমালা তৈরির কাজ করছে। তার ভাষায়, “একটি টিম এআই পলিসি তৈরিতে কাজ করছে, যা অন্যান্য চলমান নীতিমালার সঙ্গে মিলিয়ে বাস্তবায়ন করা হবে।”
বিশেষজ্ঞদের উদ্বেগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক বিএম মইনুল হোসেন বলেন, “জেনারেটিভ এআই-এর ফলে কারও কণ্ঠস্বর, চেহারা বা আচরণ নকল করা এখন খুব সহজ। এটি শুধু বাংলাদেশের নয়, সারা বিশ্বের জন্য উদ্বেগের বিষয়।”
তিনি আরও বলেন, “এআই মিসইনফরমেশন ও প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর অন্যতম হাতিয়ার হয়ে উঠছে। নীতিমালা না থাকায় এর অপব্যবহার প্রতিরোধ করা কঠিন হয়ে পড়েছে।”
আইনজীবীদের মতামত
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী রাশিদা চৌধুরী নিলু বলেন, “প্রযুক্তির ব্যবহার সীমিত না রাখলে অপব্যবহার রোধ করা অসম্ভব। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি ব্যবহারের সীমা নির্ধারণ করে একটি আইনি কাঠামো গড়ে তোলার সময় এসেছে।”
তিনি আরও বলেন, “একটি মানুষ অপরাধ করলে যেমন তার বিচার হয়, তেমনি প্রযুক্তির মাধ্যমে সৃষ্ট ক্ষতিরও বিচার হওয়া উচিত। কিন্তু বাংলাদেশে বর্তমানে এআই ব্যবহারজনিত অপরাধ দমন বা প্রতিকার পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।”
জাতীয় এআই নীতিমালার খসড়া ও বাস্তবতা
২০২০ সালে তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ একটি জাতীয় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কৌশলপত্র তৈরি করে। সেখানে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, প্রশাসন ও কৃষিসহ বিভিন্ন খাতে এআই ব্যবহারের রূপরেখা তুলে ধরা হয়। তবে এটি আজও বাস্তবায়িত হয়নি।
পরে ২০২3 সালে ‘ন্যাশনাল এআই পলিসি’-এর একটি খসড়াও তৈরি হয়, যার মূল লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশকে একটি স্মার্ট ডিজিটাল রাষ্ট্রে রূপান্তর করা। তবে সেটি এখনও চূড়ান্ত করা হয়নি।
বৈশ্বিক উদ্যোগের তুলনা
ইউরোপীয় ইউনিয়ন ২০২3 সালে একটি পূর্ণাঙ্গ এআই আইন পাস করেছে, যেখানে উচ্চঝুঁকিপূর্ণ ব্যবস্থাগুলো আলাদা শ্রেণিভুক্ত করে কঠোর নিয়ম নির্ধারণ করা হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রেও রয়েছে একাধিক আইন ও নির্বাহী আদেশ—যেমন: ‘এআই ইন গভর্নমেন্ট অ্যাক্ট’, ‘ন্যাশনাল এআই ইনিশিয়েটিভ অ্যাক্ট’, ইত্যাদি।
চীন অ্যালগরিদম ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে, যাতে তা রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপে ব্যবহৃত না হয়।
ভারত, কানাডা ও সংযুক্ত আরব আমিরাতেও রয়েছে খাতভিত্তিক এআই কৌশল।
বাংলাদেশের প্রস্তুতির ঘাটতি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মইনুল হোসেন বলেন, “যে জিনিসগুলো বিশ্বের অন্যান্য দেশ দশ বছর আগে করেছে, বাংলাদেশে সেগুলোর কোনো ভিত্তি নেই। কোনো এআই প্রযুক্তি যদি মানুষের ক্ষতি করে, তবে জবাবদিহি কোথায়?”
তিনি আরও বলেন, “সম্প্রতি সাইবার সিকিউরিটি অধ্যাদেশ ২০২৫-এ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা উল্লেখ থাকলেও তার কোনো সমন্বিত রূপ নেই। একটি কার্যকর পলিসি হলে তাতে কারা নজরদারি করবে, সেটাও নির্ধারিত থাকে।”
প্রযুক্তিবিদদের ভিন্নমত
তবে ফাইবার অ্যাট হোম লিমিটেডের প্রধান তথ্য কর্মকর্তা সুমন আহমেদ সাবিরের মতে, “বিদ্যমান আইনেই প্রযুক্তি ব্যবহার করে করা অপরাধের বিচার সম্ভব। অপরাধটি কীভাবে সংগঠিত হয়েছে—তা বোঝাই মূল বিষয়। তা মোবাইল, এআই বা অন্য যেকোনো প্রযুক্তি হোক।”
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও চ্যালেঞ্জ
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন, “কোন খাতে এআই ব্যবহার করা যাবে এবং যাবে না—এই সীমানা নির্ধারণ করা এখন সময়ের দাবি। ব্যক্তিগত পর্যায়ে অনেকেই এর সুবিধা নিচ্ছেন, কিন্তু জাতীয় পর্যায়ে এর বিশাল সম্ভাবনা এখনো ব্যবহার করা যাচ্ছে না।”
উপসংহার
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শুধু আইন নয়, এআই সংশ্লিষ্ট মানবসম্পদ গড়ে তোলাও জরুরি। নীতিমালা, আইন ও ব্যবস্থাপনার অভাবে বাংলাদেশ এখনও এআই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রস্তুত নয়। তবে এখনই ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে এর সামাজিক, রাজনৈতিক ও নিরাপত্তাগত বিপর্যয় আরও গভীর হতে পারে।
