হ-বাংলা নিউজ: বাংলাদেশ সচিবালয় বহুমুখী সমবায় সমিতিতে দীর্ঘদিন ধরে ভয়াবহ অনিয়ম, অর্থ আত্মসাৎ ও দুর্নীতির চিত্র উঠে এসেছে সমবায় অধিদপ্তরের তদন্তে। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ধারাবাহিকভাবে নির্বাচিত ও অনির্বাচিত পরিচালকরা সমিতির অর্থ লুটপাটে জড়িত ছিলেন।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, কোনো ব্যবস্থাপনা কমিটি তাদের পূর্ববর্তী কমিটির আয়-ব্যয়ের হিসাব গ্রহণ করেনি। এমনকি গাজীপুরে সমিতির কেনা সাড়ে ৪৮ কাঠা জমি দখল করে সাবেক নেতারা নিজেদের নামে লিখে নিয়েছেন, যা বর্তমানে প্রায় ৯ কোটি ৭০ লাখ টাকা মূল্যের সম্পদ।
ক্যান্টিনে প্রতিদিন ১ থেকে ১.১০ লাখ টাকার বেচাকেনা হলেও সমিতি লাভবান হচ্ছে না। উল্টো রয়েছে ২৯ লাখ টাকার গ্যাস বিল বকেয়া। বিভিন্ন পাইকারি দোকানে রয়েছে আরও কয়েক লাখ টাকা দেনা।
এছাড়া, অবসরপ্রাপ্ত ও মৃত সদস্যদের শেয়ারের নামে ২৬ লাখ টাকা আদায় করে বর্তমান ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যরা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছেন। প্রতিটি শেয়ার ১১০০ টাকা দরে বিক্রি করে ফান্ডে জমা রাখা হয়েছে মাত্র ১০০ টাকা, বাকিটুকু জনপ্রতি ১.৫ লাখ টাকা হিসেবে ভাগ হয়েছে।
কোনো নিয়োগ নীতিমালা নেই, কর্মচারীদের বেতন বাকি
সমিতি গঠনের ৫০ বছর পার হলেও এখন পর্যন্ত কোনো নিয়োগনীতি তৈরি হয়নি। বর্তমানে কর্মরত ৩৩ জন কর্মচারীর বেতন ও বোনাস বকেয়া রয়েছে কয়েক লাখ টাকা।
ক্যান্টিন-দোকান আছে, লাভ নেই
সচিবালয় ও পরিকল্পনা কমিশনের আওতায় বরাদ্দ পাওয়া তিনটি ক্যান্টিন, একটি মুদি দোকান, চা স্টল, বেকারি, পান-সিগারেটের দোকান, ফাস্টফুডের স্টল ইত্যাদি থাকলেও, এসব প্রতিষ্ঠান থেকে তেমন কোনো আয় নেই। অথচ ক্যান্টিন চালাতে বিদ্যুৎ ও পানির বিলও দিতে হয় না—শুধু গ্যাস বিলেই সীমাবদ্ধ।
আইন না মেনে সদস্য নিয়োগ ও কমিটি গঠন
২০২২ ও ২০২২-২৩ সালে কোনো বিধি অনুসরণ না করেই ২ হাজার ২৯ জনকে সদস্য করা হয়েছে। সমবায় আইন অনুযায়ী ভোটার তালিকা বৈধ না হওয়ায় ২০২৩ সালের ১৬ মার্চ গঠিত বর্তমান ব্যবস্থাপনা কমিটি বাতিলের সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি।
এছাড়া বার্ষিক সাধারণ সভা না করা, বার্ষিক অডিট না করাকে গুরুতর আর্থিক অনিয়ম হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
জমি আত্মসাৎ: সম্পদ বেহাত
১৯৮২-৮৪ সালের মধ্যে গাজীপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় সমিতির নামে কেনা সাড়ে ৪৮ কাঠা জমি ১৯৯৩ সালের মধ্যে সে সময়ের নেতারা নিজেদের নামে লিখে নিয়েছেন। বর্তমানে প্রতি কাঠার দাম ২০ লাখ টাকা হলেও সমিতির দখলে নেই জমিটি। অফিসে কেবল একটি পর্চা ছাড়া কোনো বৈধ দলিলও নেই।
সাবেক ও বর্তমান কমিটির দায়
প্রতিবেদন অনুযায়ী, আর্থিক লেনদেনের কোনো রেকর্ড সংরক্ষণ করা হয়নি। বার্ষিক বাজেট অনুমোদন ছাড়াই ব্যয় নির্বাহ করা হয়েছে। ফলে গুরুতর বিধি লঙ্ঘনের প্রমাণ মিলেছে। তদন্ত কমিটি সুপারিশ করেছে—বর্তমান কমিটিকে দায়ী করে ব্যয়কৃত অর্থ ফেরত আদায়ের ব্যবস্থা নেওয়া হোক।
কর্মকর্তার মন্তব্য
সমিতির সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমান বলেন, “আমার দায়িত্ব নেওয়ার সময় আগের কমিটি ৫০ হাজার টাকা ঋণ রেখে গেছে, ২৬ লাখ টাকার গ্যাস বিল বাকি ছিল। আয় না থাকায় কর্মচারীদের বেতন দিতে পারি না।” তবে শেয়ার বিক্রির ২৬ লাখ টাকা আত্মসাতের বিষয়ে তিনি বলেন, “আমি কোনো টাকা নেইনি।”
ম্যানেজার মো. রুহুল আমীন বলেন, “১৯৯৩ সাল থেকে কর্মরত। এখানে কেউ কর্মচারীদের কল্যাণে কাজ করেনি। সবাই আসে নিজেদের আখের গোঁছাতে। প্রতিদিনের বাজারেও অর্থ আত্মসাৎ হয়, কোনো হিসাব দেওয়া হয় না।”
তিনি আরও বলেন, “২০২৩ সালের নতুন কমিটি সবচেয়ে বেশি অনিয়ম করেছে, অথচ তাদের কাছেই স্বচ্ছতার আশা ছিল সবচেয়ে বেশি।”
তদন্ত প্রতিবেদন উপসংহার
সমবায় অধিদপ্তর তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, কোটি কোটি টাকার সম্পদ আত্মসাৎ, বাজেটহীন ব্যয়, সদস্য তালিকায় অনিয়ম, নিরীক্ষাহীন লেনদেন, জমির জালিয়াতি ও হিসাবহীন শেয়ার বিক্রি—সব মিলিয়ে সমিতির বর্তমান ও অতীত কমিটিগুলো গুরুতর দায়িত্বহীনতা ও দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত।
এগুলোর জন্য আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ ও দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির সুপারিশ করা হয়েছে।
