হ-বাংলা নিউজ: বাংলাদেশে স্পেসএক্সের স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেবা ‘স্টারলিংক’ চালু হলে প্রযুক্তি, অর্থনীতি, ই-লার্নিং, শিল্প খাত এবং নারীর ক্ষমতায়নে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে। বিশেষত, দুর্যোগকালীন সময়ে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে স্টারলিংক ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। এর ফলে বাজারে প্রতিযোগিতাও বৃদ্ধি পাবে, যা ইন্টারনেট সেবার মূল্য কমাতে সহায়ক হতে পারে। ভয়েস অব আমেরিকা এ বিষয়ে বিস্তৃত প্রতিবেদন করেছে।
স্টারলিংক চালু করার উদ্যোগ
২০২৫ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এবং স্পেসএক্সের মালিক ইলন মাস্কের মধ্যে এক ভিডিও কনফারেন্সে স্টারলিংক সেবা চালু করার বিষয়ে আলোচনা হয়। এই আলোচনায় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এসডিজির প্রধান সমন্বয়কারী লামিয়া মোর্শেদ এবং স্পেসএক্সের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) নন-জিওস্টেশনারি অরবিট (এনজিএসও) স্যাটেলাইট সেবা প্রদানকারীদের জন্য একটি গাইডলাইন তৈরি করেছে, যা বর্তমানে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে রয়েছে।
বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, স্টারলিংকের মতো নন-জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইট প্রযুক্তি দেশের প্রান্তিক অঞ্চলে উচ্চগতির, তারবিহীন এবং নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সংযোগ সরবরাহ করতে সক্ষম হবে। এসব এলাকার জন্য স্টারলিংক একটি কার্যকর সমাধান হতে পারে, যেখানে ফাইবার অপটিক বা মাইক্রোওয়েভের মাধ্যমে ইন্টারনেট সংযোগ পৌঁছানো সম্ভব নয়।
ইন্টারনেট সেবায় নতুন সম্ভাবনা
ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব জানিয়েছেন, ‘বিটিআরসি নন-জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইট সেবা চালু করার জন্য একটি নীতিমালা তৈরি করেছে, যেখানে ইন্টারনেট সেবার মূল্য প্রতিযোগিতামূলকভাবে কমানোর চেষ্টা করা হয়েছে।’
এছাড়া, সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে, স্টারলিংক বাংলাদেশের ডিজিটাল প্রযুক্তির উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে, যা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ব্যবসা এবং ফ্রিল্যান্সিংসহ অনলাইনভিত্তিক বিভিন্ন কার্যক্রমের জন্য নতুন দিক উন্মোচন করবে।
ই-লার্নিং ও শিক্ষা খাতে প্রভাব
বিটিআরসি এবং প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্টারলিংক চালু হলে দেশের গ্রামীণ ও তৃণমূল অঞ্চলের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে উচ্চগতির ইন্টারনেটের সংযোগ বাড়ানো সম্ভব হবে। এর ফলে ই-লার্নিং, ভার্চুয়াল ক্লাসরুম এবং আধুনিক শিক্ষার সুবিধা বৃহত্তর জনগণের কাছে পৌঁছাবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘স্টারলিংক প্রযুক্তির মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা আন্তর্জাতিকভাবে আরও সংযুক্ত হতে পারবে, যা তাদের জ্ঞান এবং দক্ষতা উন্নত করবে।’
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব জানান, ২০৩০ সালের মধ্যে পৃথিবীর সব স্কুল ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের আওতায় আনার জন্য ইউনেস্কো নির্দেশনা দিয়েছে। বাংলাদেশে বর্তমানে স্কুলগুলোর মাত্র ২৪% ইন্টারনেট সুবিধা পাচ্ছে, এবং এই চ্যালেঞ্জে স্টারলিংক কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
গ্রামীণ অর্থনীতির বিকাশ
বিটিআরসি থেকে জানানো হয়েছে, স্টারলিংক গ্রামীণ উদ্যোক্তাদের জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি করবে। ই-কমার্স, ডিজিটাল মার্কেটিং এবং অনলাইন পেমেন্ট সিস্টেমে যুক্ত হয়ে তারা আন্তর্জাতিক বাজারে তাদের পণ্য বিক্রি করতে পারবে। এটি স্থানীয় কর্মসংস্থান এবং আয়ের সুযোগ বাড়াবে।
নারীর ক্ষমতায়নে ভূমিকা
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্টারলিংকের প্রযুক্তি নারীদের ঘরে বসে ই-কমার্স এবং ফ্রিল্যান্সিংয়ের মতো কাজগুলোতে অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করবে। এর মাধ্যমে নারীরা আর্থিক স্বাবলম্বী হয়ে তাদের সামাজিক অবস্থান শক্তিশালী করতে পারবেন।
বিটিআরসি কর্মকর্তারা জানান, ‘স্টারলিংকের মাধ্যমে নারীরা মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্য, শিশু স্বাস্থ্য, অনলাইন শিক্ষা, গার্হস্থ্য ও কৃষি বিষয়ে তথ্য পাচ্ছেন, যা তাদের ক্ষমতায়ন বাড়াবে।’
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন, ‘নারীদের জন্য বিশেষ বিজনেস প্যাকেজ এবং প্রমোশন চালু করা হলে, নারীরা উদ্যোক্তা হিসেবে এগিয়ে আসতে সক্ষম হবে।’
দুর্গম অঞ্চলে ডিজিটাল বিপ্লব
বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দুর্গম অঞ্চলে ফাইবার অপটিক ক্যাবল ব্যবহার করে ইন্টারনেট সেবা পৌঁছানো কঠিন। এই অঞ্চলের জন্য স্টারলিংক একটি কার্যকর সমাধান হতে পারে, যা স্থানীয় উদ্যোক্তাদের অনলাইন ব্যবসায় সংযুক্ত করতে এবং সামাজিক অন্তর্ভুক্তি বাড়াতে সহায়তা করবে।
স্যাটেলাইট ইন্টারনেট ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা
স্টারলিংক স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেবা দুর্যোগকালীন সময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এটি উদ্ধারকাজ, তথ্য শেয়ারিং এবং জরুরি সেবায় দ্রুত সমন্বয় প্রতিষ্ঠা করতে সহায়ক হবে। বিটিআরসি জানিয়েছে, ‘দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় স্টারলিংক একটি কার্যকর বিকল্প হতে পারে।’
স্টারলিংক সরঞ্জাম সহজলভ্য করার উদ্যোগ
বিটিআরসি জানিয়েছে, স্টারলিংকের ইন্টারনেট কানেক্টিভিটি ডিভাইসের খরচ কমানোর জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। কিস্তি মাধ্যমে ডিভাইস সরবরাহ এবং সহজ অর্থনৈতিক প্যাকেজ চালু করা হলে, এটি আরও সুলভ হবে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সরকার যদি কর হ্রাস এবং আমদানি শুল্ক রেয়াত দেয়, তাহলে স্টারলিংকের সেবা ব্যাপকভাবে জনগণের কাছে পৌঁছাবে।
উপসংহার
স্টারলিংক বাংলাদেশের ডিজিটাল উন্নয়ন, শিক্ষা, অর্থনীতি এবং নারীর ক্ষমতায়নে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে। প্রযুক্তির মাধ্যমে গ্রামীণ এবং দুর্গম এলাকার জনগণের জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি হবে, যা দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে সহায়ক হবে।
