টবি ক্যাডম্যান: ‘আইসিটি’ বিচার প্রক্রিয়ার সমালোচক, এখন প্রধান পরামর্শক

হ-বাংলা নিউজ:  ২০১০ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরুর পর, এর স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন ব্রিটিশ আইনজীবী ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ও মানবাধিকার আইন বিশেষজ্ঞ টবি ক্যাডম্যান। তখন ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করলে, ২০১১ সালে শেখ হাসিনার সরকার তাকে বাংলাদেশে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল।

গত এক দশকে জামায়াত নেতাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের মামলায় আইনি সহায়তা ও পরামর্শ দেওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশের আইনজীবী হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছেন ক্যাডম্যান। ট্রাইব্যুনালের ‘নিরপেক্ষতা ও প্রক্রিয়াগত ত্রুটি’ নিয়ে তিনি দীর্ঘদিন সোচ্চার ছিলেন। এখন তিনি অন্তবর্তী সরকার গঠনের পর ট্রাইবুনালের আইনি পুনর্গঠনের প্রধান পরামর্শক হিসেবে কাজ করছেন। আওয়ামী লীগ আমলে বিচারবহির্ভূত হত্যা, জোরপূর্বক গুম, নিখোঁজ ও বিশেষভাবে জুলাই-আগস্টের হত্যাকাণ্ডের বিচার কার্যক্রমে প্রসিকিউশন টিমকে পরামর্শ দিচ্ছেন তিনি।

অতীতে ট্রাইবুনালের কঠোর সমালোচক হিসেবে পরিচিত ক্যাডম্যান এখন প্রতিষ্ঠানটির প্রধান পরামর্শক। পটপরিবর্তন ও নতুন ভূমিকায় নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করতে গিয়ে যুগান্তরের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “ট্রাইবুনাল নয়, আমি এর বিচার প্রক্রিয়ার সমালোচক ছিলাম।”

ক্যাডম্যান আরও বলেন, “এটা পরিষ্কার করতে চাই যে, আমি কখনও ট্রাইবুনাল প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ছিলাম না, তবে আমি এর বিচার প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে ছিলাম। বাংলাদেশের মূল সমস্যা হলো নিজ ইতিহাসের সঠিক মূল্যায়ন না করতে পারা। দীর্ঘ ৪০-৫০ বছর ধরে এর জন্য কোনো জবাবদিহিতা ছিল না। আমার মতে, ১৯৭১ সালের ঘটনা আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে অনেক আগেই নিষ্পত্তি হওয়া উচিত ছিল। তবে তা না হওয়ায় বিচারহীনতার শূন্যতা তৈরি হয়। এরপর ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার ক্ষমতায় আসার পর এই প্রক্রিয়া শুরু হয়। ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয় এবং কয়েকজন বিরোধী নেতার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। আমি মূলত এই বিচার প্রক্রিয়ার সমালোচনা করেছি, যা শুধু আমার নয়, জাতিসংঘ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ অনেক মানবাধিকার সংগঠনও সমর্থন করেছে।”

গত জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে আওয়ামী লীগ সরকার, দলীয় ক্যাডার ও প্রশাসনের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি অংশের জড়িয়ে পড়া গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার এখন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে চলছে। এই প্রেক্ষাপটে ক্যাডম্যান বলেছেন, “ভুলের পুনরাবৃত্তি এড়াতে হলে ট্রাইবুনালের সক্ষমতা বাড়ানো প্রয়োজন। তবে, বিচার প্রতিশোধমূলক নয়, এটি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার প্রক্রিয়া।”

ইংল্যান্ড ও ওয়েলস বারের সদস্য ক্যাডম্যান আরও বলেন, “শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকাকালীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের (আইসিটি) আইন সংশোধন করা হয়েছে। আমি প্রধান প্রসিকিউটর তাজুল ইসলামের সঙ্গে আরও কিছু প্রয়োজনীয় পরিবর্তনের সুপারিশ করেছি। কিছু কাঠামোগত পরিবর্তন এখনও প্রয়োজন, এবং এর প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা আরও জোরদার করতে হবে।”

ক্যাডম্যান বসনিয়ায় যুদ্ধাপরাধ তদন্ত ও বিচারের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণভাবে জড়িত ছিলেন। সেখানে তিনি প্রসিকিউটর দলের সদস্য হিসেবে কাজ করেছেন এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আওতায় আনার জন্য আইনি সহায়তা দিয়েছেন। বাংলাদেশেও তিনি যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়ায় সক্রিয় হয়েছেন।

বর্তমানে তিনি ট্রাইবুনালের নতুন নামকরণের জন্য সুপারিশ করেছেন, কারণ পুরনো নামটি বিচার প্রক্রিয়ার আগের বিতর্কের স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়। তিনি বলেন, “আইসিটি নামটি মানুষকে আগের বিচার প্রক্রিয়ার স্মৃতি মনে করিয়ে দেবে, যেখানে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ছিল। নাম পরিবর্তন না হলে, আইনি কাঠামো পরিবর্তন করলেও, এটি আগের ঘটনার ছায়া বহন করবে।”

টবি ক্যাডম্যান ট্রাইবুনাল সংস্কার ও পুনর্গঠনে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত দলনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির উপর গুরুত্ব দিয়েছেন। তার মতে, যে দলই অপরাধ করুক, তাকে বিচারের আওতায় আনা উচিত। বিচারকদের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন, যাতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ না হয়। তিনি বলেন, “এটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কর্তৃক সঠিকভাবে সমর্থিত হওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ।”

২০১১ সালে বাংলাদেশে প্রবেশের সময় তাকে বিমানবন্দরে আটক করা হয়েছিল। সে সময় তিনি তার মত প্রকাশ করলেও, এখন তিনি বলেন, “তখন আমরা পুরোপুরি বুঝতে পারিনি, বিচার প্রক্রিয়ায় কতটা রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ চলছে।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *