হ-বাংলা নিউজ:
আমার বইমেলার অভিজ্ঞতা ঢাকাতেই, এবং বিদেশের কোনো বইমেলা দেখার সুযোগ আমার হয়নি। তবে বাংলাদেশের বইমেলা সম্পর্কে আমার যে অভিজ্ঞতা, তা সত্তরের দশক থেকে শুরু। তখন বাংলাদেশের একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং দেশপ্রেমিক প্রকাশক চিত্তরঞ্জন সাহা তাঁর ‘মুক্তধারা’ প্রকাশনীর কিছু বই বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গণে একটি আলোচনা অনুষ্ঠানের পাশে ঘাসের ওপর চাদর বিছিয়ে বিক্রি শুরু করেছিলেন। এটাই ছিল বাংলাদেশের প্রথম বইমেলার সূচনা, এবং আমি সে সময় থেকেই এর অংশীদার।
আমার মনে আছে, ‘মুক্তধারা’ প্রকাশনীর জন্ম ‘পুঁথিঘর’ নামক এক ‘নোটবই’ প্রকাশনার মধ্য দিয়ে, যা ছাত্রদের সহায়ক গ্রন্থ ছিল। মুক্তধারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশপ্রেম এবং প্রগতিশীল ধারার বই প্রকাশ শুরু করে। এটা ছিল এক সাহসী এবং দূরদর্শী উদ্যোগ। সেই সময়, সৃজনশীল বইয়ের প্রায় কোনো অস্তিত্বই ছিল না, বই মানেই ছিল স্কুল-কলেজের পাঠ্যবই এবং সহায়ক নোটবই। কিন্তু ‘মুক্তধারা’ বইকে মুক্তি দিল এবং নবীন লেখকদের স্বীকৃতি দিল।
চলতি বইমেলা অনেক বড় পরিসরে বিস্তৃত হলেও, এর শুরুটা ছিল খুবই ছোট, তবে ঐতিহাসিক। ‘মুক্তধারা’ সৃজনশীল বইয়ের জন্য একমাত্র প্রকাশক ছিল, আর অন্য প্রকাশকরা তখন সৃজনশীল বই প্রকাশ করতে ভয় পেত। তারা যে বই প্রকাশ করত, তা ছিল প্রবীণ লেখকদের—যেমন আবুল কালাম শামসুদ্দীন, সরদার জয়েন উদ্দীন, গোলাম মোস্তফা, আবুল মনসুর আহমদ প্রমুখের বই। নবীন লেখকদের বই প্রকাশ হতো স্বাধীনতার পর, বিশেষত সত্তরের শেষ এবং আশির দশক থেকে, এবং এর পথিকৃৎ ছিল চিত্তরঞ্জন সাহা এবং তাঁর ‘মুক্তধারা’ প্রকাশনী।
এরপর, বাংলা একাডেমি এই বইমেলাকে তাদের বার্ষিক কর্মসূচির অংশ হিসেবে গ্রহণ করে এবং প্রকাশকদের জন্য আহ্বান জানায়। প্রকাশকরা তখন ছোট ছোট স্টল সাজিয়ে তাদের বই বিক্রি শুরু করেন, এবং মেলা ব্যাপক জনসমর্থন লাভ করে। একে সাধারণ মানুষ ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করল, এবং প্রকাশকরা নতুন বই ছাপতে উৎসাহিত হন। বইমেলার মাধ্যমে এক নতুন সামাজিক সম্প্রীতির সৃষ্টি হয়, যেখানে প্রকাশক, লেখক, পাঠক এবং সংস্কৃতিবান মানুষ একত্রিত হয়।
কিন্তু, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গণ ছোট হয়ে যাওয়ায়, মেলা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সম্প্রসারিত হয়। এখন, বড় পরিসরে বইমেলা হচ্ছে, স্টলগুলোতে নান্দনিকতা এসেছে, বৈচিত্র্য এসেছে। তবে, পাঠক এবং দর্শকদের ভিড় থাকলেও, বইয়ের বিক্রি কম হচ্ছে। চিত্তরঞ্জন সাহা যেমন বইকে জীবনের অংশ হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন, তেমনভাবে বর্তমানে প্রকাশকদেরও উদ্ভাবনী চিন্তা এবং ‘সেলস প্রমোশন’ করতে হবে।
বর্তমানে বইয়ের বাজার বেশ চ্যালেঞ্জিং, কারণ বই কেনার ক্ষমতা মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত শ্রেণির জন্য কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। এজন্য, প্রকাশকদের জন্য ‘সেলস প্রমোশন’-এর উদ্ভাবনী আইডিয়া প্রয়োজন, যাতে বই সহজেই পাঠকের কাছে পৌঁছাতে পারে। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে কাজ করে, এবং পত্রিকা, টেলিভিশন ও রেডিওর প্রচারের সুযোগ কাজে লাগিয়ে বইয়ের বিক্রি বাড়ানো সম্ভব।
এছাড়া, মেলার মাঠে শিশু, নারী এবং প্রবীণদের জন্য বিশেষ সুবিধা প্রদান করতে হবে, এবং লেখক-পাঠক-প্রকাশকসহ বিভিন্ন মানুষের মধ্যে আলাপ-আলোচনা শুরু করতে হবে। বইকে হৃদয়ে পৌঁছাতে হবে, শুধু মোড়ক উন্মোচন নয়। বইমেলা যেন হয়ে ওঠে একটি জীবনমেলা, যেখানে বইয়ের ‘সত্তা’ পাঠকের হৃদয়ে স্পন্দিত হয়।
