হেমন্তের বিকাল ও স্মৃতির মাঝে মেঘু শিকদারের গল্প

হ-বাংলা নিউজ: হেমন্তের বিকেলটি মনোরম এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা। পাকা ধানের মাঠে শেষ বেলার রোদ ঝলমল করছে। মাঠের মাঝখানে, গাছপালায় ঘেরা এক খামারবাড়ি, যা দেখে জাহিদ স্মৃতিচারণা করতে শুরু করল। ‘‘তোর মনে আছে শহিদ, বিলের ওই দিঘি? বিশাল দিঘিটি ছিল, চারপাশে হিজলগাছ আর বেতঝোপ। সেখানে অনেক রক্ত শাপলা ফুটত। ডাহুক পাখির ডাক ছিল সেখানে, আর দুপুর-বিকেল-রাতের নির্জনতায় গ্রামের প্রতিটি কোণ ডাহুকের ডাকেই মুখর হয়ে উঠত।’’

শহিদ তার সাদা দাড়িতে হাত বুলিয়ে বলল, ‘‘মনে থাকব না কেন? ওই মাঠে তো আমরা প্রায়ই খেলতাম!’’

জাহিদের চশমা নাকের ডগায় নেমে এসেছে। তিনি চশমা উপরে ঠেলে দিয়ে বললেন, ‘‘গ্রামের অনেক কিছুই ভুলে গেছি, তবে ওই দিঘি আর মাঠের কথা কখনোই ভুলিনি। একদিন, আব্বা রেডিও কিনে আনলেন। এক দুপুরে সেই রেডিওতে একটি গান শুনেছিলাম। ‘‘পদ্মদিঘির ধারে ধারে, ডাহুক ডাকা মাঠের পাড়ে, কানামাছি খেলার কথা যায় কি ভোলা…’’ গানটা এখনো মনে পড়ে। মনে পড়লেই সেই দিঘির পাড়ের মাঠটা দেখতে পাই, ডাহুক পাখিগুলোর ডাক শুনতে পাই। হেমন্তের বিকালে তাদের ডাক শুনতে যে কত মায়া, মনে হয় তারা শুধু ডাকছে না, যেন কাঁদছে।’’

জাহিদ বুক-প্যাক থেকে সিগারেট বের করলেন এবং শহিদের দিকে বাড়িয়ে দিলেন। শহিদ হাসলেন, ‘‘না, দোস্ত, এখন আর খাই না। হার্টে রিং পরেছি, ডাক্তারের নিষেধ। সব ছেড়ে দিয়েছি, এখন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি। শরীর ভালো আছে।’’

সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে, জাহিদ শহিদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘‘শহিদ, মেঘু শিকদারের কথা মনে আছে?’’

‘‘অবশ্যই। তিন-চার বছর বড় ছিল। ডাউক ধরার নেশা ছিল তার। একটি পোষা ডাউক ছিল। সেই নিয়ে দিঘির ধারে আর বিলে ঘুরত। হাতে ডাউক ধরার খাঁচা। ডাউক ধরে বিক্রি করত। তবে সে ছিল গল্পের ওস্তাদ, একবার গল্প শুরু করলে আর থামত না।’’

‘‘বেঁচে আছে?’’

‘‘হ্যাঁ, তবে পঙ্গু। হাঁটাচলা করতে পারে না। সংসারে অভাব। বড় ছেলেটা ট্রাকের ড্রাইভার, ছোটটা চায়ের দোকান দিয়েছে। তাদের সংসারে অনেক ছেলে-মেয়ে। নিজের সংসারই ঠিকমতো চলে না, বাপের জন্য কী করবে? মেঘু এখন সংসারের বোঝা।’’

জাহিদ বললেন, ‘‘চল, বাড়ির দিকে যাই। ঢাকায় ফিরতে হবে। গাড়ি তো আমাদের বাড়িতে।’’

শহিদ বললেন, ‘‘সকালে তো গিয়েছিলে। আমার বাড়িতে থাক। দুজন বন্ধু রাতে গল্প করব। কাল সকালে মেঘু শিকদারের বাড়ি যাবো, তার ডাউক ধরার কাহিনি শুনব। ভাবিরে ফোন করে দে।’’

জাহিদ দ্রুত ফোন করে জানিয়ে দিলেন, এবং ড্রাইভারকে নির্দেশ দিলেন গাড়ি নিয়ে তাদের বাড়িতে চলে আসতে। এরপর বললেন, ‘‘সন্ধ্যায় তো তোর বাড়িতে বসে কী করব? তার চেয়ে এখনই মেঘু শিকদারের গল্প শুনে আসি।’’

শহিদ হাসলেন, ‘‘ও ঠিক আছে, শরীর পঙ্গু হলেও জবান পঙ্গু হয়নি। পুরনো গল্পই শুনবো।’’


দোচালা টিনের ঘরে মেঘুর দুটি ছেলে থাকে। বড় আমগাছের পাশে চারপাশে খোলা রান্নাঘর। দুটি মাটির চুলায় রাতের ভাত বসেছে। উঠোনের কোণে একটি বড় জামগাছ, তার তলায় পাটখড়ির বেড়া দিয়ে তৈরি ছাপরা ঘর। এখানেই মেঘু শিকদারের বাস, এখন লেছড়ে লেছড়ে চলাফেরা করে। বিকেলের দিকে, ওই অবস্থাতেই তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, তার মুখে সাদা গোঁফ-দাড়ি, সাদা চুল, এবং বেশ কিছু দাঁত।

জাহিদ আর শহিদ মেঘুর কাছে পৌঁছালে তিনি বললেন, ‘‘কে? কারা আসল?’’

শহিদ তাকে পরিচয় দিলেন, ‘‘মেঘুদাদা, আমি শহিদ।’’

মেঘুর চোখে কিছুটা আলো ছিল। শহিদকে দেখে তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ‘‘ও, শহিদ? আস দাদা, আস। কী মনে করে আসলা? সঙ্গে কে? সাহেব মানুষ। তারে তো চিনতে পারলাম না।’’

‘‘পরিচয় দিলেই চিনবেন। আমার দোস্ত, মির্জাবাড়ির জাহিদ।’’

মেঘু উত্তেজিত হয়ে উঠলেন, ‘‘আরে, কী বলেন! জাহিদদাদাকে চিনব না! বহুত বছর পর দেখলাম। মির্জাবাড়ির কেউ তো আর গ্রামে আসে না, তবে তুমি আসছ, আমাকেও দেখতে আসছ, খুব খুশি হলাম। বস, বস।’’

জাহিদ ও শহিদ বসে চা পান করতে করতে মেঘু শিকদারের জীবন ও তার ডাউক ধরার কাহিনি শুনতে শুরু করলেন। মেঘু বললেন, ‘‘ডাউক ধরার নেশা আমাকে শেষ করে দিয়েছে। একবার বর্ষাকালে তিনটি ডাউকের বাচ্চা ধরেছিলাম। তাদের মধ্যে একটি বাচ্চা বেঁচে গিয়েছিল, তাকে এতটা পোষ মানিয়েছিলাম, সে আমার পিছে পিছে হাঁটত। কিন্তু একদিন সে মারা যায়, আর আমি সেই কান্না শুনে অভিশাপ পাই। সেদিনের পর থেকে আমি শারীরিকভাবে পঙ্গু হয়ে গেছি। আমি যেভাবে ডাউকদের ক্ষতি করেছি, আল্লাহর বিচারই এখন আমার উপর হচ্ছে।’’

মেঘু দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, ‘‘এখনো রাতে, আকাশের নিচে যখন নিরবতা থাকে, আমি কেবল ডাউকের কান্না শুনি। কষ্টের সঙ্গে মনে হয়, আমি যে পাপ করেছি, তার ফলাফল এখন আমাকে ভুগতে হচ্ছে।’’

শহিদ আর জাহিদ চুপ করে বসে রইলেন, মেঘুর কথাগুলি গভীরভাবে ভাবতে লাগলেন। মেঘুর চোখ আকাশের দিকে ছিল, যেখানে জ্যোৎস্নার আলো ধীরে ধীরে পড়ে যাচ্ছিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *