হ-বাংলা নিউজ: বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির চাপ কমছে না, বরং তা আরও বাড়ছে—এ নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবরে গত তিন মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি দেখা গেছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার কারণে বাজারে দাম কমছে না। অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, বাজারে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে এবং এর ফলে সাধারণ মানুষের ওপর চাপ বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর জানিয়েছেন, মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে আনার জন্য আরও আট মাস প্রয়োজন হবে। (খবর: ডয়েচে ভেলে)
মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতি
বিবিএসের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবরে দেশের মূল্যস্ফীতি বেড়ে ১০.৮৭ শতাংশে পৌঁছেছে। খাদ্যপণ্য, বিশেষ করে চাল ও সবজির দাম বেড়েছে, যার ফলে মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পর, অক্টোবরে মূল্যস্ফীতি গত তিন মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। এর আগে, সেপ্টেম্বরে সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯.৯২ শতাংশ, আর আগস্টে ১০.৪৯ শতাংশ। বিবিএস জানিয়েছে, অক্টোবরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে ১২.৬৬ শতাংশে পৌঁছেছে, যা জুলাইয়ে ছিল ১০.৪০ শতাংশ। একই সময়ে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯.৩৪ শতাংশ, যা এক মাস আগে ছিল ৯.৫ শতাংশ।
বাংলাদেশ প্রায় দুই বছর ধরে ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতির সঙ্গে লড়াই করছে। ২০২৩ সালের মার্চ মাস থেকে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে রয়েছে। গত বছরের অক্টোবরে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯.৯৩ শতাংশ, আর সেপ্টেম্বরে ৯.৯২ শতাংশ।
সরকারের উদ্যোগ
মূল্যস্ফীতি কমাতে সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে, যার মধ্যে পেঁয়াজ ও ডিমসহ অন্যান্য পণ্যের আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়েছে। তবে বাজারে এই পদক্ষেপের প্রভাব তেমন পড়ছে না। সম্প্রতি, চাল, আলু, পেঁয়াজ, ভোজ্যতেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়তে থাকে। আলুর দাম কেজিতে ১৫ থেকে ২০ টাকা, চালের দাম কেজিতে ৪ থেকে ৫ টাকা, সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ১০ থেকে ১২ টাকা, পেঁয়াজের দাম ২৫ থেকে ৩৫ টাকা, রসুনের দাম ২০ থেকে ৪০ টাকা বেড়েছে।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক মূল্যস্ফীতি কমাতে আমদানির জন্য এলসি মার্জিন তুলে দিয়েছে, সিঙ্গেল বরোয়ার লিমিটও বাতিল করেছে। পাশাপাশি, নীতি সুদ (রেপো) হার বাড়ানো হয়েছে। অক্টোবরে রপ্তানি বেড়েছে ১৯ শতাংশ এবং প্রবাসী আয়ও বাড়ছে, ফলে ডলার সরবরাহ বেড়েছে। তবুও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসছে না।
কেন এই পরিস্থিতি?
যমুনা ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নুরুল আমীন বলেন, “এলসি মার্জিন তুলে দেওয়ায় আমদানি সহজ হবে এবং ব্যবসায়ীরা বেশি ঋণ পাবেন। কিন্তু বাজারে এখনো সিন্ডিকেট সক্রিয়। পণ্য থাকলেও সরবরাহ চেইনে সমস্যা সৃষ্টি করে দাম বাড়ানো হচ্ছে। আলুর দাম ৮০ টাকা কেজি হওয়া—এটা তো সবার কাছেই অবিশ্বাস্য।”
তিনি আরও বলেন, “বাজারে কোনো পণ্যের সংকট নেই, কিন্তু বাজার মনিটরিংয়ের অভাবের কারণে দাম কমছে না। সরকার বাজারে দৃশ্যমান মনিটরিং না করলে শুল্ক প্রত্যাহার বা অন্যান্য পদক্ষেপের কোনো প্রভাব থাকবে না।”
ক্রেতা ও বিশেষজ্ঞদের মতামত
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সিনিয়র সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, “বাজার মনিটরিংয়ের কোনো উন্নতি হয়নি। টিসিবির লাইনে যে পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে, তাতে বোঝা যায় সরকার আসলে বাজার নিয়ন্ত্রণে কতটুকু সক্ষম।” তিনি প্রশ্ন তোলেন, “আমদানির শুল্ক প্রত্যাহারের সুবিধা কারা নিচ্ছে, বাজারে এর কোনো প্রভাব কেন পড়ছে না?”
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মো. আইনুল ইসলাম বলেন, “খাদ্যপণ্যের দাম বাড়লে, সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় নিম্ন আয়ের মানুষ। বিশেষ করে পেঁয়াজ, আলু, ব্রয়লার মুরগি, ডিমের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে অক্টোবরে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পেয়েছে।”
সরকারের বক্তব্য
নতুন বাণিজ্য উপদেষ্টা সেখ বশির উদ্দিন বলেছেন, “আমি মানুষের কষ্ট বুঝি এবং বাজারে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে কাজ করব। মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের খরচ বেড়েছে, কিন্তু ক্রয়ক্ষমতা বাড়েনি।” তিনি জানান, “এটি কোনো একক মন্ত্রের মাধ্যমে সমাধান সম্ভব নয়, একসঙ্গে কাজ করতে হবে।”
অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন, “মনে হয়, বাজারে যে বিশৃঙ্খলা চলছে, তা সহজে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব নয়। তবে আমি চেষ্টা করছি দাম কমানোর জন্য, কারণ জনগণের জন্য এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”
