গত ১৫ বছরে অর্থনীতির সব খাত ধ্বংস হয়েছে, তবে বাংলাদেশের দেউলিয়া হওয়ার শঙ্কা নেই: অর্থ উপদেষ্টা

হ-বাংলা নিউজ: ঢাকা, ১১ নভেম্বর ২০২৪: দেশের অর্থনীতি গত ১৫ বছরে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বক্তারা। তারা বলেন, সরকার এবং ব্যবসায়ীরা একত্রে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ করতে দায়ী হয়েছেন। গত কয়েক বছরে দুর্বৃত্তরা ব্যাংক খাত থেকে কয়েক লাখ কোটি টাকা নিয়ে বিদেশে পাচার করেছে, যার কারণে দেশের আর্থিক খাত এখন অত্যন্ত দুর্বল। তবে, শ্রীলংকার মতো বাংলাদেশের দেউলিয়া হওয়ার সম্ভাবনা নেই, কারণ বর্তমান সরকার অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার জন্য কাজ করছে এবং কোনো ব্যক্তিগত এজেন্ডা এখানে নেই।

সোমবার রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁওয়ে অনুষ্ঠিত ‘তৃতীয় বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সম্মেলন’-এ এসব মন্তব্য করেন অর্থনীতির বিশিষ্ট ব্যক্তিরা।

এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাণিজ্য এবং বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সেখ বশির উদ্দিন, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান, সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, এডিবি-র কান্ট্রি ডিরেক্টর হোয়ে ইউন জিয়ং এবং বিএনপি নেতা ও ন্যাশনাল ব্যাংকের চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন বণিক বার্তার সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ

অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “দেশের স্বার্থে যা কিছু করা হচ্ছে, তা ভবিষ্যতে যে কোনো সরকারও চালিয়ে যেতে পারবে। আমাদের কারও ব্যক্তিগত এজেন্ডা নেই।” তিনি জানান, সরকার বর্তমানে অর্থনৈতিক সমস্যাগুলোর সমাধান তিনটি ধাপে ভাগ করে কাজ করছে—স্বল্প, মধ্যম এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। তিনি বলেন, কিছু দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ পরবর্তী সরকারের হাতে থাকবে, তবে বর্তমান সরকারও কিছু দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে।

তিনি বলেন, “গবেষণাগুলোর ফলাফল দ্রুত বাস্তবায়ন করার জন্য সিদ্ধান্তগুলো দ্রুত নেওয়া হচ্ছে, তবে তা জনগণের স্বার্থে করা হচ্ছে।”

বৈষম্য ও অপরাধ

অর্থ উপদেষ্টা আরও বলেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বৈষম্য দুটি দিক থেকে স্পষ্ট—একটি যা চোখে পড়ছে এবং আরেকটি যা চোখে পড়ছে না। তিনি বলেন, গরিব মানুষদের জন্য সুযোগের বৈষম্য রয়েছে এবং তারা সরকারি সুযোগ-সুবিধাগুলো জানেন না। তিনি বলেন, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে বৈষম্য রয়েছে, যেখানে গরিবরা সহজে উন্নত চিকিৎসা বা শিক্ষা সুবিধা পাচ্ছে না।

সেখ বশির উদ্দিন

সেখ বশির উদ্দিন বলেন, “গত ১৫ বছরে দেশের সব খাত ধ্বংস হয়ে গেছে এবং সবাইকে অপরাধী বানানো হয়েছে। ব্যবসায়ীরা রাজনীতিতে এসে ব্যবসাকে রাজনীতিকরণ করে ফেলেছেন। এতে দেশের ব্যবসায়িক পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।” তিনি আরও বলেন, ব্যাংকিং খাতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক যে পদক্ষেপ নিয়েছে তা প্রশংসনীয়। তিনি বলেন, “মূল্যস্ফীতির সমস্যা মোকাবিলা করা সম্ভব, যদি আমরা সঠিক নিয়ামকগুলো চিহ্নিত করতে পারি।”

ড. আহসান এইচ মনসুর

ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, “বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দুর্বৃত্তরা ব্যাংক থেকে কয়েক লাখ কোটি টাকা পাচার করেছে। তবে, শ্রীলংকার মতো আমরা দেউলিয়া হইনি এবং প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক হয়নি।” তিনি জানান, “বাংলাদেশ ব্যাংক গত তিন মাসে কোনো টাকা ছাপায়নি, তবুও তা নিয়ে কোনো সমস্যা সৃষ্টি হয়নি।” তিনি আরও জানান, ব্যাংকিং খাতে অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে এবং “যারা টাকা বিদেশে পাচার করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।”

অন্যান্য বক্তা

এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান দেশের আমদানির তথ্যে স্বর্ণের পরিমাণ কম হওয়া সত্ত্বেও জুয়েলারিতে বিশাল পরিমাণ স্বর্ণের উপস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, “এই পরিস্থিতির বিরুদ্ধে আমাদের আরও কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে।”

ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, দেশের “সামষ্টিক অর্থনীতি এবং কর্মসংস্থান সমস্যার সমাধান করতে রাজনৈতিক অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজন। বিনিয়োগ নেই, ফলে দেশে অস্থিরতা সৃষ্টি হচ্ছে।” তিনি মনে করেন, সরকারের নীতি গ্রহণের ক্ষেত্রে আরো কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন।

আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বিএনপি ক্ষমতায় এলে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির ৫ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হবে। তিনি বলেন, “মেগা প্রকল্পগুলো অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক নয়, এগুলো মূলত শোভাবর্ধনকারী প্রকল্প।”

এছাড়া, ইস্ট কোস্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান আজম জে চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. সায়মা হক বিদিশা, ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএম) নির্বাহী পরিচালক ড. মুস্তফা কে মুজেরী, এবং ইউনিলিভার বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জাভেদ আখতারসহ অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিরা অনুষ্ঠানটিতে বক্তৃতা করেন।

এই আলোচনা সভাটি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, বৈষম্য দূরীকরণ এবং স্থিতিশীল অর্থনীতির জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপগুলো নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা প্রদান করে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *