‘আইনভিত্তিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা’ পশ্চিমা পররাষ্ট্রনীতির চ্যালেঞ্জ আমেরিকা

হ-বাংলা নিউজ: আইনভিত্তিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা’ (রুলবেজড ইন্টারন্যাশনাল অর্ডার) দীর্ঘদিন ধরেই নানা মারাত্মক বিচ্যুতির সম্মুখীন হচ্ছে। সাধারণ মানুষের কাছে এই ধারণাটি অনেকটাই অর্থহীন মনে হচ্ছে, ফলে এটি একটি শূন্যপ্রাণ ধারণায় পরিণত হয়েছে। জনগণ স্বাধীনতা বা মাতৃভূমির রক্ষার জন্য যুদ্ধ করতে পারে, কিন্তু কেউই এই ‘আইনভিত্তিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা’ রক্ষার জন্য লড়াই করতে বা মরতে প্রস্তুত নয়।

এছাড়া, পশ্চিমা বিশ্বের প্রভাবশালী নীতিনির্ধারকরা এখনও এই ধারণার প্রতি গভীরভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বলে মনে হচ্ছে। চীন সফরের সময় যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ‘আইনভিত্তিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা’র গুরুত্ব তুলে ধরেন। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকও এই ধারণাকে যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রনীতির কেন্দ্রে রেখেছেন। তাঁর সম্ভাব্য উত্তরসূরি স্যার কেয়ার স্টারমার, যিনি একজন আইনজীবী, তিনিও এই ধারণার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ব্লিঙ্কেন যুক্তি দেখিয়েছেন যে যুক্তরাষ্ট্র নগ্ন ক্ষমতার বিরুদ্ধে নয় বরং আইনভিত্তিক বিশ্বের পক্ষে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু আইন মানে হলো সংগতিপূর্ণ পদক্ষেপ, যা আমেরিকার নিজস্ব কর্মকাণ্ডে অনেক ক্ষেত্রে উপেক্ষিত হচ্ছে।

বিগত দুই সপ্তাহে আমেরিকার বিভিন্ন বিরোধপূর্ণ পদক্ষেপ প্রকাশ পেয়েছে। চীনের তৈরি বৈদ্যুতিক যানবাহনের ওপর বাইডেন প্রশাসনের আরোপিত শতভাগ আমদানি শুল্ক আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের বিধানের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ নয়। এটি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) বিধি-নিষেধের বিপরীত।

ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আনার পদক্ষেপে আমেরিকার প্রতিক্রিয়া গুরুত্বপূর্ণ। আন্তর্জাতিক আইন প্রয়োগে বৈশ্বিক আদালতকে সমর্থনের বদলে ব্লিঙ্কেন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসকে আইসিসির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের চিন্তা করার কথা বলেছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে নানা যুক্তি দেওয়া হতে পারে, যেমন আইসিসি তার এখতিয়ার লঙ্ঘন করেছে বা চীন আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করছে। তবে রাশিয়া ও চীন নিজেদের কর্মকাণ্ডকে আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গতিপূর্ণ বলে দাবি করে, এমনকি যখন তা মোটেও সঠিক নয়। যুক্তরাষ্ট্রও কখনও কখনও এই কৌশল ব্যবহার করতে পারে।

বর্তমান বিশ্বে, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও ইউক্রেনের মতো গণতান্ত্রিক দেশগুলো কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রগুলোর, প্রধানত চীন ও রাশিয়ার ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ মোকাবিলা করতে হিমশিম খাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে মুক্তবিশ্বের পক্ষে অবস্থান নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ।

আইনভিত্তিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করার চেয়ে মুক্তবিশ্বের পক্ষে অবস্থান নেওয়া আরও কার্যকর। যদিও এই ব্যবস্থা কিছুটা অসামঞ্জস্য ও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে পারে। ঠান্ডা যুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা অগণতান্ত্রিক সরকারগুলোর সঙ্গে কৌশলগত মৈত্রী গড়ে তুলেছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটানোর জন্য।

আজকের বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্র আবারও কর্তৃত্ববাদী শক্তিগুলোর সঙ্গে বৃহত্তর লড়াইয়ের স্বার্থে কিছু অস্বস্তিকর ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান নিচ্ছে। চীনা বৈদ্যুতিক যানবাহনের ওপর শুল্ক আরোপের মতো পদক্ষেপটি মূলত চীনের শিল্প আধিপত্য ঠেকানোর চেষ্টা হিসেবে দেখা যেতে পারে।

দক্ষিণ চীন সাগরের মালিকানা নিয়ে চীনের দাবিকে যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের সমুদ্রবিষয়ক সনদের লঙ্ঘন হিসেবে উল্লেখ করেছে, যদিও যুক্তরাষ্ট্র নিজে এই সনদে স্বাক্ষর করেনি। এ পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য আইনভিত্তিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা রক্ষা করা নয়, বরং একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যপথ কর্তৃত্ববাদী দেশের নিয়ন্ত্রণে চলে না যায়, তা নিশ্চিত করা।

ইসরায়েলের বিষয়ে বাইডেনের পদক্ষেপ অনেকটাই যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির প্রতিফলন। গণতান্ত্রিক মিত্রদের রক্ষা করার বাসনা তার ইসরায়েলকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন দেওয়ার পিছনে রয়েছে। গাজায় নেতানিয়াহুর কর্মকাণ্ডকে অপরাধ হিসেবে অস্বীকার করা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বিব্রতকর হতে পারে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের একমাত্র গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র যখন কাঠগড়ায়, সিরিয়া ও ইরানের নেতারা তাদের অপরাধের বিচার এড়াচ্ছে—এমন পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের অস্বস্তি বোঝা যায়।

আইনভিত্তিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা নিয়ে বাড়াবাড়ি করে আলোচনা করার অর্থ এই নয় যে আন্তর্জাতিক আইন পরিত্যাগ করতে হবে। এটি আসলে বিশ্বের জন্য অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করবে। অনেক আন্তর্জাতিক আইন রয়েছে, যার বিরোধিতা করা কঠিন। ভ্লাদিমির পুতিন এবং সম্ভবত নেতানিয়াহু শিগগিরই দেখবেন যে তাদের আন্তর্জাতিক সফর পরিকল্পনা আইসিসির গ্রেপ্তারি পরোয়ানার কারণে সীমিত হয়ে গেছে।

গিডিয়ন রাঞ্চম্যান ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসের আন্তর্জাতিক বিষয়ক প্রধান ভাষ্যকার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *