রানা দাশগুপ্ত। বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রসিকিউটর। আওয়ামী লীগ সরকার টানা ১৪ বছরের বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় আছে। এই সময়ে সংখ্যালঘুরা কি বেশি সুযোগ-সুবিধা পেয়েছেন, তাঁদের ওপর হামলা কি বন্ধ হয়েছে, আগামী নির্বাচনে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় কী ভূমিকা নেবে—এসব প্রশ্ন নিয়ে প্রথম আলো মুখোমুখি হয় রানা দাশগুপ্তর।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান ও মনোজ দেগত বছর এক সাক্ষাৎকারে আপনি বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের মধ্যে অনেকে আছেন, যাঁরা চান না সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষা হোক। কারা তাঁরা?
রানা দাশগুপ্ত: সরকারের মধ্যে তো সরকার আছে, দলের মধ্যেও দল আছে, আমলাতন্ত্রে পাকিস্তান আছে, প্রশাসনে সাম্প্রদায়িকতা আছে। এসব কারণে পার্বত্য চুক্তি হওয়া সত্ত্বেও সেটি কার্যকর হয় না, ভূমি কমিশন হওয়া সত্ত্বেও তা বাস্তবায়িত হয় না। আবার অর্পিত সম্পত্তি আইন পরিবর্তিত হয়ে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন হয়েছে। ২০১১ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত ছয়টি সংশোধনী এনে এটিকে আরও ইতিবাচক করা হয়েছে। কিন্তু এরপর ৯ বছর হয়ে গেল। সমতলের সংখ্যালঘুরা ভূমির অধিকার ফিরে পাননি, জাতিগত সংখ্যালঘুদের ভূমির অধিকার আজও নিশ্চিত হয়নি। এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছা আছে বলে মনে করি। সদিচ্ছা না থাকলে এসব চুক্তি বা আইন হতো না। কিন্তু জমি ফেরত দেওয়ার ক্ষেত্রে বাধা দেওয়া হচ্ছে। সেটা করছে কারা? আমরা সেখানে বলছি আমলাতন্ত্রে ভূত আছে, সেটা পাকিস্তানি ভূত। তারা পাকিস্তানি মানসিকতা নিয়ে আজও প্রশাসন ও সরকারকে চালাতে চায়। সরকারি দলের মধ্যেও সেটা আছে।
কুমিল্লার ঘটনাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন? সংখ্যালঘুদের ওপর বৈষম্য ও অত্যাচার করার জন্য বিএনপিকে বর্জন করেছিলেন। আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আসতে সহায়তা করেছেন। আওয়ামী লীগ কি আপনাদের সেই সুরক্ষা দিয়েছে?
রানা দাশগুপ্ত: ১৯৯০ সালে এরশাদবিরোধী আন্দোলন যখন তুঙ্গে, সেই আন্দোলন বিভ্রান্ত করার জন্য বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলেছে, এ কথা বলে ঢাকা ও চট্টগ্রামে তিন দিন রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা হয়েছে। গণ-আন্দোলনের মুখে এরশাদ পদত্যাগ করলেন, সংসদীয় নির্বাচন হলো। ১৯৯১ সালে নির্বাচনে বিএনপি জয়লাভ করে। সেদিনই বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়া বিবৃতি দিলেন। বিবৃতিতে তিনি সবাইকে শান্ত থাকার কথা বললেন এবং কোনো ধরনের সমস্যা যাতে সৃষ্টি না হয়, তার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানালেন। বিবৃতির পর আমরা আশ্বস্ত হয়েছিলাম। কিন্তু পরদিন থেকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা শুরু হলো। চলল একটানা ২৭ দিন। স্বাধীন বাংলাদেশে আমরা এ ধরনের সহিংসতা আশা করিনি। কিন্তু পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর থেকে সেটি শুরু হয়েছিল। ২০০৮ সালের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করল। সেই সরকারের আমলে আগের সরকারের মতো সহিংসতার পুনরাবৃত্তি ঘটবে, সেটা আমাদের ভাবনার অতীত ছিল। কিন্তু সেই যে ২০১১ সালে রামু, উখিয়া, টেকনাফ থেকে শুরু হলো; ২০২১ সালের দুর্গাপূজার সময় পর্যন্ত একটানা সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। সে অর্থে বিএনপি সরকারের আমলে যত ঘটনা ঘটেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তার চেয়ে কম ঘটেছে বলে আমরা মনে করছি না।
কোনো তফাত কি দেখতে পান?
রানা দাশগুপ্ত: তফাত হলো, বিএনপি সরকারের আমলে কোনো ঘটনার এজাহার হতো না। ভয়ে কেউ আদালতে যেতেন না। এ সরকারের আমলে এজাহার হয়, চার্জশিট হয়, কিন্তু বিচার হয় না। এসব ঘটনায় সরকারি দলের লোক জড়িত থাকলে অভিযোগপত্র থেকে তাঁদের নাম বাদ দেওয়া হয়। মামলা এমনভাবে সাজানো হয়, যেন ১৫-২০ দিনের মধ্যে আসামিরা সবাই জামিনে বেরিয়ে আসেন।
আইনজীবী হিসেবে আপনার কাছে প্রশ্ন হচ্ছে, সংখ্যালঘুদের ক্ষেত্রেই এ ধরনের ঘটনা ঘটছে নাকি বাংলাদেশে সার্বিক আইনের শাসনের ঘাটতির কারণে সেটি হচ্ছে?
রানা দাশগুপ্ত: এ দেশে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হতে ২১ বছর সময় লেগেছে। যদি বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বা বিশেষ বিচার হতো, তাহলে এত দিন লাগত না। আমরা মনে করি, সমাজের দুর্বল অংশ হওয়ায় নারী ও শিশুদের সুরক্ষায় যেমন বিশেষ আইন আছে, সংখ্যালঘুদের সুরক্ষার জন্যও বিশেষ আইন থাকা প্রয়োজন। এ কারণে আমরা সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়নের দাবি জানিয়েছিলাম। সরকারি দলও সে দাবি মেনে নিয়েছিল। বৈষম্য বিলোপ আইনের দাবি তুলেছিলাম। সরকার ইতিমধ্যে সেটা করার উদ্যোগ নিয়েছে। যারা দলিত ও অচ্ছুত, তাদের জন্য এটি ইতিবাচক আইন। কিন্তু সামগ্রিকভাবে সংখ্যালঘুদের জন্য এ আইন খুব বেশি উপকারে আসবে না। সংখ্যালঘুদের এখনকার সংকট হলো নিরাপত্তাহীনতা বোধ। সেটা থেকে সংখ্যালঘুদের মুক্ত করতে হলে সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করা জরুরি। আমাদের দাবির যৌক্তিকতা মেনে নিয়ে সরকারি দল তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়নের অঙ্গীকার করেছিল। কিন্তু সরকারের মেয়াদ এক বছরও বাকি নেই। আমরা মনে করি, এ সময়ের মধ্যে এ আইন পাস হওয়া উচিত। সংখ্যালঘুরা যে ভয়ের সংস্কৃতির মধ্যে আছেন, তাঁদের আশ্বস্ত করার জন্য এ আইন জরুরি।আওয়ামী লীগ একটানা ১৪ বছর ক্ষমতায়। বর্তমানে সংখ্যালঘুরা কেমন আছেন?
রানা দাশগুপ্ত: দেশের উন্নয়ন হয়েছে, মাথাপিছু আয় বেড়েছে। এর একটা হিস্যা সব নাগরিকই পেয়েছেন। ১৪ বছর আগের থেকে এখন সংখ্যালঘুদের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটেছে, কিন্তু সেটা কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে পৌঁছায়নি। কেননা এ ক্ষেত্রে বৈষম্য আছে। গ্রামগঞ্জ বা প্রান্তিক এলাকায় সংখ্যালঘুরা বিধবা ভাতাসহ প্রায় সব সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির বাইরে থেকে যান। এ জন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি দায়ী।
অনেকে বলেন, এ সরকারের আমলে প্রশাসনে অনেক ক্ষেত্রে সংখ্যালঘুরা অনেক বেশি সুবিধা পেয়েছেন?
রানা দাশগুপ্ত: হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ গঠনের সময় আমরা স্লোগান তুলেছিলাম—ধর্মীয় রাষ্ট্র নয়, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র এবং জাতীয় জীবনের সব ক্ষেত্রে জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে অংশীদারত্ব ও প্রতিনিধিত্ব চাই। এ দাবি তোলার সময় সংসদে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্য ছিলেন মাত্র দুজন। এখন সংসদে সদস্য ২৩ জন। বিগত সময়ে আমরা দেখেছি, শুধু নামের কারণে অনেক যোগ্য ব্যক্তিকেও চাকরিতে নিয়োগ দেওয়া হয়নি, নিয়োগ দিলেও তাঁর পদোন্নতি হয়নি। জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে অংশীদারত্ব ও প্রতিনিধিত্ব গত ১৪ বছরে এ ক্ষেত্রে দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়েছে। যেমন পুলিশ প্রশাসনে আগের চেয়ে সংখ্যালঘুদের অংশগ্রহণ বেড়েছে। আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য কেউ ছিলেন না, এখন হচ্ছেন।২৩ জন সংসদ সদস্য আছেন। সংসদে কি তাঁরা আপনাদের পক্ষে কথা বলেন?
রানা দাশগুপ্ত: একদম বলছেন না। যেকোনো নাগরিক বা গোষ্ঠীর গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সমস্যা সমাধানের একমাত্র ফোরাম হলো সংসদ। আমরা কখনো ভাবিনি, এখনো ভাবি না সংসদে আলাদাভাবে সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধি যাওয়া দরকার। গণতান্ত্রিক দলগুলোর মধ্য থেকেই এই প্রতিনিধিত্ব থাকা উচিত। কিন্তু দুজন সংসদ সদস্য থাকার সময়ে তাঁরা যে ভূমিকা তখন পালন করেছিলেন, আজ ২৩ জন সেই ভূমিকা পালন করছেন না। আজ যদি তাঁরা সংসদের ভেতর তাঁদের ভূমিকা পালন করতে পারতেন, তাহলে কেবল সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নয়, সরকার ও সরকারি দল লাভবান হতো।
তারপরও তো আপনারা আওয়ামী লীগ সরকারের ওপরই ভরসা করছেন?
রানা দাশগুপ্ত: এ মুহূর্তে কোনো রাজনৈতিক দলের নেতাদের ওপর আমাদের আস্থা বা ভরসা নেই। তবে প্রধানমন্ত্রীর ওপরে এখনো আমাদের আশা, আস্থা ও ভরসা টিকিয়ে রাখতে চাই। শত প্রতিকূলতার মাঝে দেশটাকে ইতিবাচকভাবে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন তিনি। এ দেশের সংখ্যালঘুরা যে তাঁদের ভোটের ক্ষেত্রে অন্য কোনো দলকে আস্থায় নেবেন, সেই বাস্তবতা নেই। কেননা অন্য কোনো বড় দল সংখ্যালঘুদের আস্থায় আনার চেষ্টা করেনি।
