বাংলাদেশের পানি সংকট: ভূগর্ভস্থ পানি কমছে, সুপেয় পানি দুষ্প্রাপ্য

হ-বাংলা নিউজ:

পুকুর, দিঘি, জলাশয় ভরাট, দ্রুত নগরায়ণ, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের অভাব এবং অপরিকল্পিত পানি উত্তোলনের কারণে দিন দিন ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিম্নমুখী হচ্ছে। এতে করে বাড়তি জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে সুপেয় পানির উৎসও ক্রমাগত সংকুচিত হচ্ছে। ভূগর্ভস্থ পানির বিকল্প হিসেবে, বিশেষজ্ঞরা ভূপৃষ্ঠের উপরিভাগের পানি ব্যবহারের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন, যাতে ভূগর্ভস্থ পানির রিজার্ভ রক্ষা করা যায়।

রাজধানী ঢাকায় সরবরাহ করা পানি এমনকি ফুটিয়ে পান করতে হয়। চট্টগ্রাম শহরের পানি লবণাক্ত, যা জনগণের জন্য বিপজ্জনক। রাজশাহীর পানিতে ময়লা এবং দুর্গন্ধ রয়েছে, খুলনায় ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের পানি ফুটিয়ে না খেলে পান করা যায় না। এমনকি গভীর নলকূপের পানি আর্সেনিক এবং লবণাক্ততায় ব্যবহার করা ঝুঁকিপূর্ণ। এসব পরিস্থিতির মধ্যে আজ বিশ্ব পানি দিবস পালিত হচ্ছে, যার এবারের প্রতিপাদ্য হলো হিমবাহ সংরক্ষণ।

এ বিষয়ে ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিংয়ের (আইডব্লিউএম) নির্বাহী পরিচালক এসএম মাহবুবুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, “বাংলাদেশে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার শহরাঞ্চলে প্রতিদিনের ব্যবহারে এবং গ্রামাঞ্চলে কৃষিতে বেড়ে গেছে। এর ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। এটি প্রতিরোধে ভূ-উপরিস্থ উৎসের পানির ব্যবহার বাড়ানোর জন্য সরকারের নির্দেশনা থাকলেও তা কার্যকর হচ্ছে না।”

সংশ্লিষ্টরা জানান, সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর পানি ব্যবস্থাপনার দুর্বলতায় মিঠা পানি সমৃদ্ধ বাংলাদেশেও সুপেয় পানি দুষ্প্রাপ্য হয়ে পড়েছে। দেশের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ এখন সুপেয় পানির সংকটে। খরার মৌসুমে সুপেয় পানির জন্য হাহাকার শুরু হয়। প্রকল্প বাস্তবায়ন করেও নিরাপদ পানি নিশ্চিত করা যাচ্ছে না, এমনকি জরিপেও এ সমস্যা প্রতিভাত হয়েছে। বাংলাদেশের পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, দেশের ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার ৬১৬ জন মানুষের মধ্যে ৫৯% (৯ কোটি ৭৪ লাখ) সুপেয় পানির সুবিধা পাচ্ছে, তবে ৪১% (৬ কোটি ৭৭ লাখ) মানুষ সুপেয় পানির বাইরে রয়েছে। ১০% মানুষ এখনও আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করছে, যা স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি করছে।

এছাড়া, ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরের পানি সরবরাহের সমস্যা চলমান। ওয়াসা এবং জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর সুপেয় পানি সরবরাহে সক্ষমতা অর্জনের জন্য সরকারের কাছ থেকে হাজার কোটি টাকা খরচ করছে, কিন্তু ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা এবং ত্রুটিপূর্ণ সরবরাহ ব্যবস্থার কারণে এসব পানি নিরাপদ নয়। বুয়েটের পানি বিশেষজ্ঞ ড. তানভীর আহমেদ উল্লেখ করেছেন, “পাইপলাইনের মাধ্যমে সরবরাহকৃত পানিকে সুপেয় বলা যায়, তবে সেখানে কোনো ময়লা ঢুকে পড়লে সেটি আর সুপেয় পানি বলা যায় না।”

বাংলাদেশের বদ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ অনুযায়ী, দেশের এক-তৃতীয়াংশ এলাকা সুপেয় পানি প্রাপ্যতার বিবেচনায় ‘হটস্পট’ হিসাবে চিহ্নিত। এসব এলাকায় অধিকাংশ পানিই নিরাপদ নয় এবং আর্সেনিক বা আয়রন সমস্যাও রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে উপকূলীয় অঞ্চলে পানি সরবরাহ ব্যবস্থা আরো জটিল হয়ে পড়েছে, যেমন খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাটসহ বিভিন্ন এলাকার গভীর নলকূপ কার্যকর নয় এবং মানুষ বর্ষার পানি সংরক্ষণ করে ব্যবহার করছে।

এছাড়া, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে খুলনার উপকূলীয় অঞ্চলের পানির সমস্যা আরও তীব্র হয়েছে। সিডর, আইলা এবং আম্ফানসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে পানি সরবরাহ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যা পানি সংকটকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।

ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়ার কারণে ঢাকা, খুলনা, রাজশাহী ও বরেন্দ্র অঞ্চলে পানি পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। ঢাকায় এখন ৮০০ থেকে ৮৫০ ফুট নিচে নেমে পানি পাওয়া যাচ্ছে, যা স্বাভাবিক নয়। তবে চট্টগ্রাম অঞ্চলে ভূ-উপরিস্থ উৎসের যথাযথ ব্যবহার করা হচ্ছে।

পানি বিশেষজ্ঞ ড. আনোয়ার জাহিদ মন্তব্য করেছেন, “বাংলাদেশের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর যে হারে নেমে যাচ্ছে, সে হারে পানির স্তর পূর্ণ হচ্ছে না। এজন্য সরকারকে কৃত্রিমভাবে বর্ষার মৌসুমে পানি মাটির নিচে প্রবেশের উদ্যোগ নিতে হবে, নইলে ভবিষ্যতে বড় ধরনের পানি সংকট হতে পারে।”

১৯৯৩ সালে জাতিসংঘ ২২ মার্চকে বিশ্ব পানি দিবস ঘোষণা করে, এবং প্রতি বছর এই দিবসটি পালিত হয়ে আসছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *