উনবাঙাল’র আয়োজনে নিউইয়র্কে একুশের বইমেলা অনুষ্ঠিত

হ-বাংলা নিউজ:নিউইয়র্ক (ইউএনএ)অমর একুশে মহান শহীদ দিবস তথা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষ্যে শিল্প-সাহিত্য সংগঠন উনবাঙাল প্রথমবারের মতো নিউইয়র্কে তিনদিনব্যাপী বইমেলার আয়োজন করে। ‘পৃথিবী জুড়ে বাঙলী, বাঙালীর পৃথিবী’ শ্লোগান আর প্রবাসের ‘লেখক-পাঠক সংযোগ’-এর বন্ধনকে আরো ঘনিষ্ট করার লক্ষ্যে এই মেলার আয়োজন করা হয়। নিউইয়র্ক সিটির কুইন্সের জ্যামাইকাস্থ ইলহাম একাডেমীতে ২১-২৩ ফেব্রুয়ারী যথাক্রমে শুক্র, শনি ও রোববার তিনদিনব্যাপী আয়োজিত এই মেলা’র উদ্বোধন করেন প্রবীণ সাংবাদিক ও কথা সাহিত্যিক মনজুর আহমদ এবং মেলায় প্রধান অতিথি ছিলেন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী শাহ নেওয়াজ গ্রুপের কর্ণধার লায়ন শাহ নেওয়াজ। খবর ইউএনএ’র।

২১ ফেব্রুয়ারী শুক্রবার বিকেল চারটায় র‍্যালী পরবর্তী উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে একুশে বইমেলার কার্যক্রম শুরু এদিন বিকেলে ‘বইমেলার ব‍্যালী’ জ্যামাইকার ১৬৯ স্ট্রাট ও হিলসাইড এভিনিউ থেকে শুরু হয়ে ১৬৫ স্ট্রাট ও ৮৭ রোডস্থ মেলা প্রাঙ্গনে এসে শেষ হয়। এরপর একগুচ্ছ বেলুন উড়িয়ে বইমেলার উদ্বোধন করেন মনজুর আহমদ। এরপর বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন এবং একুশ ও জাগরণের গান পরিবেশিত হয় এবং প্রতীকি নির্মিত শহীদ মিনারে অতিথি ও প্রবাসীরা একে এক ফুল দিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। এসময় লায়ন শাহ নেওয়াজ, মেলা কমিটির আহবায়ক ফখরুল আলম, সদস্য সচিব আহসান হাবিব সহ কমিউনিটির বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, মেলা কমিটির কর্মকর্তা, প্রবাসী কবি, লেখক, সাংবাদিক ও সুধীরা উপস্থিত ছিলেন। এদিন মাইনাস সেলসিয়াস তাপমাত্রায় প্রচন্ড ঠান্ডার মধ্যে বিপুল সংখ্যক বাংলা ভাষী মানুষ মেলায় যোগ নেন।

একুশের বইমেলার বিশেষ আকর্ষণ ছিলো লেখকরাই মেলায় স্টল দিয়েছেন, আর পাঠকরা লেখকদের কাছ থেকে সরাসরি বই কিনেছেন, অটোগ্রাফ নিয়েছেন, ছবি তুলেছেন। এরমধ্য দিয়ে ‘লেখক-পাঠক সংযোগ’ আরো শক্তিশালী হয়েছে বলে আয়োজকদের অভিমত। মেলায় যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত লেখক-লেখিকাদের বইয়ের প্রদর্শনী ও বিক্রয়ের জন্য কয়েকটি স্টল বসানো হয়। প্রবাসী বাংলাভাষীদের মধ্যে এই মেলা বেশ আগ্রহের সৃষ্টি করে বলে অনেকেই মন্তব্য করেন। মেলায় সিনিয়র সাংবাদিক অনুবাদক অনোয়ার হোসাইন মঞ্জু, কবি-লেখক কাজী জহিরুল ইসলাম, লেখক-সাংবাদিক সাঈদ তারেক আর সাংবাদিক-লেখক হাবিব রহমানের লেকা বই বেশী বিক্রি হয়েছে বলে জানা গেছে

বইমেলার উদ্বোধনী পর্বে অন্যান্যের মধ্যে টাইম টেলিভিশনের সিইও আবু তাহের, উনবাঙাল-এর প্রতিষ্ঠাতা কবি কাজী জহিরুল ইসলাম, মেলা কমিটির আহ্বায়ক আলম, সদস্য

সচিব আহসান হাবীব প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। আলোচনা, আবৃতি, গান পরিবেশনার মধ্য দিয়ে প্রথম দিনের অনুষ্ঠান রাত নয়টা পর্যন্ত চলে।

এদিনের অন্যান্য কর্মকান্ডের মধ্যে ‘একুশ ও জাগরণের গান’ : ‘কাজী জহিরুল ইসলাম রচিত একুশের কাব্যালেখ্য ‘রক্তের দিয়ে কিনেছি মায়ের ভাষা’ পরিবেশিত হয়। সুমন শামসুদ্দিন, দিমা নেফারতিতি, আহসান হাবীব, মুন্না চৌধুরী ও সৈয়দ মাসুদুল ইসলাম টুটুল অংশ নেন। সবশেষের সঙ্গীতানুষ্ঠানে প্রবাসের শিল্পী ফারহানা তুলিম, সৌভিক রায় চৌধুরী, ঋত্যুজা, কমা চৌধুরী, সেলিম ইব্রাহীম ও মিতা হোসেন সঙ্গীত পরিবেশন করেন।

একুশের বইমেলার দ্বিতীয় দিনে শনিবার (২২ ফেব্রুয়ারী) দিনভর ছিল নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন। সেমিনার, আলোচনা, আবৃত্তি, একক বক্তৃতা, স্বরচিত কবিতা পাঠ সহ আরও ছিলো সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। ছুটির দিন হওয়ায় এদিন দর্শক সমাগম বাড়ে। বইও বেশ বিক্রি হয়। এদিনের অনুষ্ঠানমালার শুরুতেই সৈয়দ আল আমীন রাসেলের পরিচালনায় ‘আমাদের অভিবাস জীবন’ শীর্ষক সেমিনার এবং রওশন হকের সঞ্চালনায় শিশুদের ছাড়া/কবিতার অনুষ্ঠান ‘ভোরের পাখি’ পরিবেশিত হয়। এরপর সুমন সুমন শামসুদ্দিনের শামসুদি সঞ্চালনায় ‘শব্দরণ্যের নিবিড় গহনে’ শীর্ষক স্বরচিত কবিতা পাঠনের অনুষ্ঠানের প্রবাসী লেখকরা অংশ নেন। এছাড়াও ‘বাংলা কবিতার জনপ্রিয়তা কেন কমে যাচ্ছে?’ শীর্ষক বিশেষ আলোচনা হয়। ‘প্রবাস জীবন-স্বদেশ ভাবনা’ শীর্ষক মুক্ত আলোচনায় ডা. মোহাম্মদ হামিদুজ্জামান, অধ্যাপক ড. মোহসীন পাটোয়ারী ও লেখক-সাংবাদিক সাঈদ তারেক। সঞ্চালনায় ছিলেন ফখরুল আলম

এদিন ভ্রমণ বিষয়ক অনুষ্ঠান ‘পৃথিবীর পথে পথে’ বিশেষ আলোচনা অনুষ্ঠানে অংশ নেন ভ্রমণ লেখক যথাক্রমে হাবিব রহমান, আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু ও কাজী জহিরুল ইসলাম। সঞ্চালনায় ছিলেন জিএম ফারুক খান।

যুগল আবৃত্তির অনুষ্ঠান ‘একান্তে আমরা দুজন’ শীর্ষক পর্বে আবৃত্তি করেন দিমা নেফারতিতি ও আহসান হাবিব। এছাড়াও ‘গুরু শ্রী চিন্যুয়ের দ্বিভাষিক কবিতা পাঠ’ আলোচনায় অংশ নেন দিমা নেফারতিতি, যামিনী ইয়ং ও স্বাতী চক্রবর্তী। বই নিয়ে আলোচনার অনুষ্ঠান ‘বই-কথা-কও’ অনুষ্ঠানে আলোচক ছিলেন ড. আবুল কাশেম, দেওয়ান নাসের রাজা ও আব্দুল্লাহ জাহিদ। সঞ্চালনায় ছিলেন সোহেল হামিদ। আরো ছিলো আবৃত্তির অনুষ্ঠান ‘মুগ্ধ উচ্চারনের সৌরভ’, নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন ‘প্রচ্ছদের ভেতরে’, ‘আমি কেনো শিল্পের অনুরাগী’ শীর্ষক আলোচনা ও সঙ্গীতানুষ্ঠান। বিভিন্ন পর্ব সঞ্চালনায় ছিলেন ইমাম চৌধুরী ও শেলী জামান খান।

মেলার শেষ দিন রোববার (২৩ ফেব্রুয়ারী) দর্শক-শ্রোতায় মেলা প্রাঙ্গণ ছিলো পরিপূর্ণ। আবহাওয়া একটু ভালো থাকায় এদিন নিউইয়র্কে বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল মোহাম্মদ নাজমুল হুদা সহ সর্বস্তরের বিপুল সংখ্যক প্রবাসী মেলায় যোগ দেন। মেলার বিশেষ আকর্ষণ ছিলো সিনিয়র সাংবাদিক-লেখক হাসান ফেরদৌসের ‘বুদ্ধিজীবী ও স্বৈরাচার’ শীর্ষক একক বক্তৃতা। দিনের শুরুতে ‘অভিবাসী ও আমাদের অধিকার’ শীর্ষক সেমিনার সঞ্চালনা করেন কাজী ফৌজিয়া। এরপর ভায়লা সালিনা মির্জার সঞ্চালনায় ছিলো শিশুদের অনুষ্ঠঅন ‘আমরা সবাই রাজা’। রওশন হকের সঞ্চালনায় ‘শব্দরণ্যের নিবিড় গহনে’ শীর্ষক স্বরচিত কবিতা পাঠনের অনুষ্ঠানের প্রবাসী লেখকরা অংশ নেন।

রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে বিশেষ আলোচনার অনুষ্ঠান ‘তোমার আপন হাতের দোলে’-তে অংশ নেন মিতা হোসেন, মুক্তি জহির ও সোহানা নাজনীন। এই পর্ব সঞ্চালনায় ছিলেন নীন। এই পর্ব সঞ্চালনায় ছিলেন এইচ বি রিতা। এরপর ‘শিল্পাঙ্গনের নাটক’ শিরোনামে পরিবেশিত হয় সৈয়দ শামসুল হকের ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’। মোহাম্মদ নজরুল ইসলামের পরিচালনায় এতে অভিনয় করেন শাহরুখ তাসলিম, সোনিয়া পান্না, শফিউল আলম, উল্লাহ, নুসায়বাহ কবির, স্বপন কবির ও মোহাম্মদ নজর ইসলাম। এছাড়াও ছিলো ‘বাংলা নাটকের সেকাল-একাল’, বই নিয়ে আলোচনার অনুষ্ঠান ‘বই- কথা-কও’, একক গান, আবৃত্তির অনুষ্ঠান ‘মুগ্ধ উচ্চারনের সৌরভ’, নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন ‘প্রচ্ছচদের ভেতরে’ এবং ‘নজরুলের রসবোধ’ বিশেষ আলোচনা। এতে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন কাজী জহিরুল ইসলাম। আলোচনায় অংশ নেন ন সিনিয়র সাংবাদিক ও লেখক সাঈদ তারেক, সাংবাদিক ইমরান আনসারী ও কমিউনিটি অ্যাক্টিভিষ্ট নূরুল হক। সবশেষে ছিলো সঙ্গীতানুষ্ঠান। এতে প্রবাসের জনপ্রিয় শিল্পী চন্দন চৌধুরী, মরিয়ম মারিয়া প্রমুখ সঙ্গীত পরিবেশন করেন। বিভিন্ন পর্ব সঞ্চালনায় ছিলেন আহসান হাবিব, সেলিম ইব্রাহীম ও জেবুন্নেসা জোৎস্না।

একুশের বইমেলা’র শেষ দিনে ইউএনএ প্রতিনিধির সাথে আলাপকালে মেলার মূল উদ্যোক্তা কাজী জহিরুল ইসলাম বলেন, স্বল্প পরিসরে এমন একটি আয়োজনে প্রবাসীদের বিপুল সাড়া আমাদের মুগ্ধ করেছে, অনুপ্রাণিত করেছে। আমরা সবার কাছে কৃতজ্ঞ। তিনি জানান, এই মেলা প্রতিবছর আয়োজনের জন্য প্রবাসীদের পক্ষ থেকে দাবী উঠেছে। আমরা আশরা করছি সহযোগিতা পেলে প্রতিবছর ‘একুশের মেলা’ আয়োজন করা সম্ভব হবে।

আহ্বায়ক ফখরুল আলম বলেন, মাত্র ১৮ দিনের আয়োজনে এই মেলা আয়োজন করতে হয়েছে। নানা ভুল-ত্রুটি সত্ত্বেও সবার সহযোগিতায় মেল । এজন্য তিনি সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান এবং আগামী মেলায় সবার অব্যাহত সহযোগিতা কামনা করেন।

বইমেলার সদস্য সচিব আহসান হাবিব জানান, মেলা সফল হয়েছে আমরা অনুপ্রেরণা পেয়েছি। কাছ থেকে দাবী উঠেছে নিয়মিত মেলা আয়োজন করার। এজন্য তিনি সবার সহযোগিতা কামনা করেন এবং মেলা সফল করায় মিডিয়া সহ সংশ্লিস্ট সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *