পশ্চিম দিল্লির উত্তমনগর ইস্ট মেট্রো স্টেশন থেকে কিছুটা দূরে অবস্থিত ‘বাঙালি বস্তি’-র অবস্থা: ভয় এবং ডিপোর্টেশনের ঘটনা

হ-বাংলা নিউজ:

ভারতের পশ্চিম দিল্লির উত্তমনগর ইস্ট মেট্রো স্টেশন থেকে দশ মিনিটের হাঁটাপথে একটি ঘিঞ্জি গলির মধ্যে অবস্থিত একটি মহল্লা, যার নাম মুখে মুখে ‘বাঙালি বস্তি’। এই এলাকায় বসবাস করে মূলত পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার, আসামের নওগাঁ এবং বরপেটা জেলার মানুষরা। এখানকার প্রধান জনগণ হল বাংলাভাষী মুসলিমরা, যাদের কাছে মহল্লার এই নাম এসেছে।

এই বস্তির পুরুষরা সাধারণত নির্মাণস্থলে মুটে মজুরি, জঞ্জাল কুড়ানো বা রাজমিস্ত্রি কাজে ব্যস্ত থাকেন। কিন্তু গত দু’মাস ধরে তারা একটি ভয়ের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন, কারণ পুলিশ নিয়মিতভাবে তাদের এলাকায় হানা দিচ্ছে।

বস্তির সবাইকে তাদের পরিচয়পত্র, ভোটার কার্ড বা রেশন কার্ডসহ নথিপত্র সঠিকভাবে যাচাই করা হচ্ছে। যাদের কাছে সঠিক কাগজপত্র নেই, তাদেরকে পুলিশ ‘অবৈধ বাংলাদেশি’ হিসেবে সন্দেহ করে গ্রেপ্তার করছে।

কালী বস্তির আসলাম শেখ (নাম পরিবর্তিত) জানান, ডিসেম্বর থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ২০ জন বাঙালি নারী-পুরুষকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ, এর মধ্যে মাত্র তিনজন ফিরে এসেছেন। দিল্লির বিভিন্ন অঞ্চলে এমন ‘বাঙালি বস্তি’-র মধ্যে একই ঘটনা ঘটছে।

ডিল্লি পুলিশ জানিয়েছে, অভিযানে যাদের কাগজপত্র সঠিক হয়নি এবং যাদের বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবে সন্দেহ করা হচ্ছে, তাদের সবাইকে ডিপোর্ট করা হয়েছে। ডিপোর্টেশন হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে অন্য একটি দেশের নাগরিককে তার নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হয়।

ডিপোর্টেশনের প্রক্রিয়া সাধারণত দুই দেশের সম্মতির ভিত্তিতে সম্পন্ন হয়, তবে অতীতে সীমান্তে জোর করে ঠেলে দেওয়া (পুশব্যাক) যাওয়ার অভিযোগও উঠেছে।

এমনকি, দিল্লি পুলিশের বেশ কিছু কর্মকর্তা সম্প্রতি জানিয়েছেন, তারা বিস্তৃতভাবে ডিপোর্টেশন প্রক্রিয়া শুরু করেছে।

পুলিশি অভিযানের সূচনা

২০২২ সালের ১০ ডিসেম্বর, দিল্লির লেফটেন্যান্ট গভর্নর ভি কে সাক্সেনা নির্দেশ দেন, সব এলাকায় গিয়ে অবৈধ বিদেশি নাগরিকদের খুঁজে বের করতে হবে। এরপর দিল্লি পুলিশের ‘বাংলাদেশ সেল’-এর কার্যক্রম পুনরায় শুরু হয়, যা অবৈধ বাংলাদেশিদের শনাক্ত করার জন্য গঠন করা হয়।

ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে, দিল্লির সব ডিস্ট্রিক্টে অভিযান শুরু হয়। উত্তমনগর ছাড়াও, দক্ষিণ দিল্লি, বসন্ত কুঞ্জ, মহিপালপুর, শাস্ত্রী পার্ক, সীলমপুর, মদনপুর খাদার, রংপুরী, জাহাঙ্গীরপুরী ইত্যাদি এলাকায় পুলিশ অভিযান চালায়।

যত অভিযান চলেছে, ততই পুলিশ জানিয়েছে তারা অবৈধ বাংলাদেশিদের গ্রেপ্তার করেছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা মুসলিম জনগণকেই আটক করছে, তবে কোনো হিন্দু নাগরিককে গ্রেপ্তার করা হয়নি।

ডিপোর্টেশনের রাজনীতি

বিগত কয়েক মাসে দিল্লিতে অবৈধ বাংলাদেশি নাগরিকদের নিয়ে চলা অভিযানকে অনেকেই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে চালানো বলে মন্তব্য করছেন। ভারতের রাজধানীতে ২০২৫ সালের বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং দিল্লি বিজেপি সরকার উৎখাত করতে মরিয়া।

কিছু রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলছেন, এই অভিযান মূলত নির্বাচনী প্রচারের অংশ। সরকারী দলের নেতারা, বিশেষ করে আম আদমি পার্টি, এই অবৈধ বাংলাদেশিদের নিয়ে সাহায্য করার অভিযোগ তুলেছেন বিজেপি এবং অন্য রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীরা।

বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনও অভিযোগ করছে যে, অবৈধ বাংলাদেশি সন্দেহে আটককৃতদের নিয়ে পুলিশের নীরবতা এবং গোপনীয়তা বজায় রাখা হচ্ছে। এদিকে, দিল্লি পুলিশ জানায়, তারা সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের ফরেনার্স রেজিস্ট্রেশন অফিসে (FRRO) হস্তান্তর করেছে, যেখানে তাদের ডিপোর্টেশন প্রক্রিয়া শুরু হয়।

তবে, প্রশ্ন উঠছে, এই সন্দেহভাজনদের কি আসলেই নিজ দেশে পাঠানো হয়েছে, নাকি এটি শুধুই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে একটি চাল?

এফআরআরও এবং কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকা

ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন এফআরআরও (ফরেনার্স রিজিওনাল রেজিস্ট্রেশন অফিস) এসব প্রক্রিয়ার প্রধান দায়িত্বে রয়েছে। কিন্তু, দিল্লি পুলিশ এবং এফআরআরও-এর ভূমিকা নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠেছে, বিশেষ করে যে অভিযোগ উঠেছে, তারা সীমান্তের অন্য পাড়ে তাদের জোর করে ঠেলে দেয়।

এখন পর্যন্ত, বিশেষ কোনো প্রমাণ নেই যে সন্দেহভাজনরা সত্যিই তাদের নিজ দেশে ফিরেছে, যদিও কিছু অংশ ফিরে গেছে বলেও গুজব রয়েছে।

অমিত শাহের মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে, কারণ দিল্লি পুলিশ এবং বিএসএফ সমস্ত কার্যক্রম কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অধীনে পরিচালিত হয়।

অতীতে, অমিত শাহ বাংলাদেশিদের নিয়ে অনেক বিতর্কিত মন্তব্য করেছেন, এবং বর্তমানে দিল্লি পুলিশের অভিযান তার নীতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ বলে ধারণা করা হচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *