হ-বাংলা নিউজ:
ইতিহাস প্রতিটি জাতির জন্য দিকনির্দেশনার আলোকবর্তিকা। এটি জাতির সাফল্য ও ব্যর্থতার পাঠশালা। কিন্তু যখন ইতিহাস বিকৃত হয়, তখন একটি জাতি পথভ্রষ্ট হয় এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ভুল তথ্যের কাছে বন্দি হয়ে যায়। আমাদের দেশও এ ধরনের বিপদের সম্মুখীন হয়েছে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও আমরা সত্য ইতিহাস খুঁজে বের করতে সংগ্রাম করছি।
### *স্বাধীনতার বিতর্ক: কে দিলেন প্রথম ঘোষণা?*
১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কে প্রথম স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন—এ প্রশ্নটি আজও জাতিকে বিভক্ত করে রেখেছে। ইতিহাসের প্রামাণিক দলিল অনুযায়ী, মেজর জিয়াউর রহমান ২৬ মার্চ ১৯৭১ তারিখে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। নিজের জীবন ও পরিবারকে ঝুঁকির মুখে ফেলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এক অফিসার হিসেবে তিনি এ ঘোষণা দেন। এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে ড. কর্নেল অলি আহমদসহ অনেক মুক্তিযোদ্ধার সাক্ষ্য রয়েছে।
অন্যদিকে, আওয়ামী লীগ দাবি করে যে, শেখ মুজিবুর রহমান ২৫ মার্চ রাতে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তবে, ইতিহাসে এমন কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায়নি, যা এই দাবিকে সমর্থন করে। তাজউদ্দীন আহমদের মতো ঘনিষ্ঠ নেতাদের অনুরোধ সত্ত্বেও শেখ মুজিব ঘোষণা দেননি। পাকিস্তান কর্তৃক বন্দি হয়ে তিনি যুদ্ধকালীন সময় শান্তিপূর্ণভাবে কাটিয়েছেন এবং মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেননি।
### *১৬ ডিসেম্বর বনাম ২২ ডিসেম্বর: বিজয়ের সঠিক দিন কোনটি?*
১৬ ডিসেম্বর আমাদের বিজয় দিবস হিসেবে পালিত হয়, কারণ সেদিন ভারতীয় সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। এটি নিঃসন্দেহে একটি গৌরবময় দিন। তবে ২২ ডিসেম্বর মুজিবনগর সরকার ঢাকায় ফিরে আসে এবং বাংলাদেশের পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করে। তাই প্রশ্ন ওঠে, ২২ ডিসেম্বরকে কি আমাদের বিজয় দিবস হিসেবে ঘোষণা করা উচিত?
### *ইতিহাসের বিকৃতি: জিয়া ও অন্যান্য নেতাদের অবদানের উপেক্ষা*
স্বাধীনতার পর থেকে ইতিহাসে মেজর জিয়াউর রহমানের অবদানকে ইচ্ছাকৃতভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে। তাকে স্বাধীনতা বিরোধী হিসেবে উপস্থাপন করার প্রচেষ্টা চলেছে। একইসঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যর্থতাগুলি আড়াল করা হয়েছে।
তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র বাহিনীর অবদান, মৌলানা ভাসানীসহ অন্যান্য নেতাদের ভূমিকা, এবং মুসলিম ঐতিহ্যকে ইতিহাস থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। নবাব সিরাজউদ্দৌলা থেকে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, তিতুমীর, এবং হাজী শরীয়তুল্লাহর মতো নেতাদের অবদান ভুলে গিয়ে ইতিহাসকে সংকুচিত করা হয়েছে।
### *মুসলিম ঐতিহ্যের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপমান*
ভারতীয় প্রভাবিত বর্ণনার কারণে মুসলিম শাসকদের আক্রমণকারী হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যদিও তারা বাংলা ভালোবেসেছেন, এখানেই বসবাস করেছেন এবং জনগণের জন্য কাজ করেছেন। এমনকি নবাব সিরাজউদ্দৌলার বীরত্বকেও ভুলে যাওয়া হয়েছে।
### *ভারতীয় প্রভাব ও জাতির অবমূল্যায়ন*
স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের অবদানকে অতিরঞ্জিত করে দেখানো হয়েছে, যা আমাদের জাতীয় প্রচেষ্টাকে ক্ষুদ্র করে তুলেছে। ভারতের সঙ্গে বিজয়ের কৃতিত্ব ভাগাভাগি করার বিষয়টি ইতিহাসের একটি বড় ট্র্যাজেডি।
### *সমাধানের প্রয়োজন: সত্য ইতিহাসের পুনর্নির্মাণ*
জাতীয় স্বার্থে আমাদের ইতিহাসের অসঙ্গতিগুলি সমাধান করা অত্যন্ত প্রয়োজন। ইতিহাসবিদদের উচিত জাতির সামনে সত্য ইতিহাস তুলে ধরা। কারণ, ইতিহাস শুধু অতীত নয়; এটি আমাদের ভবিষ্যতের পথপ্রদর্শক।
আমাদের সময় এসেছে বিকৃতির ফাঁদ থেকে বেরিয়ে সত্য ইতিহাসের খোঁজে এগিয়ে যাওয়ার। আজকের প্রজন্ম এবং আগামী দিনের ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের জন্য এই চেষ্টাটি অবশ্যই করতে হবে।
*(লেখক সৈয়দ মোয়াজ্জেম হুসেইন, কলাম লেখক, সমাজসেবক ।)*
