ডেল্টা লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানির বিরুদ্ধে প্রতারণা ও দুর্নীতির অভিযোগ, বনানী থানায় এজাহার দাখিল

হ-বাংলা নিউজ: 

বিশেষ প্রতিবেদক

ঢাকা: ডেল্টা লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের একজন পাবলিক শেয়ারহোল্ডার মানিক রতন চাকমা বনানী থানায় একটি আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দায়ের করেছেন, যেখানে কোম্পানির কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বড় ধরনের প্রতারণা, তথ্য জালিয়াতি এবং আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়েছে। অভিযোগে বলা হয়েছে, কোম্পানির শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে অবৈধভাবে শেয়ার এবং পরিচালক পদ দখল করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ধরনের অসাধু কার্যকলাপ চালানো হয়েছে।

মানিক রতন চাকমা, যিনি ডেল্টা লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানির একজন শেয়ারহোল্ডার, দাবি করেছেন যে তিনি ১৯৮৬ সালের ১৭ ডিসেম্বর থেকে কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত। শুরুর দিকে ২০ জন উদ্যোক্তা শেয়ারহোল্ডার দ্বারা প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিটি বাংলাদেশের একটি শীর্ষস্থানীয় বীমা প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত ছিল। তবে চাকমার অভিযোগ, মানজুরুর রহমান, সুরাইয়া রহমান, আদিবা রহমান, জিয়াদ রহমান, সাইকা রহমান এবং আনিকা রহমানসহ কিছু ব্যক্তি অবৈধভাবে কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার পদে অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থে কোম্পানির পরিচালনা কৌশলকে প্রভাবিত করেছেন।

এজাহারে বলা হয়েছে, এসব আসামি, যারা আইনগতভাবে ‘স্পন্সর ডিরেক্টর’ হওয়ার যোগ্য ছিলেন না, তারা বিভিন্ন দালালি এবং জালিয়াতির মাধ্যমে নিজেদেরকে স্পন্সর ডিরেক্টর হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। তারা কোম্পানির বার্ষিক সাধারণ সভায় (এজিএম) অংশগ্রহণ করে নিজেদেরকে স্বীকৃত শেয়ারহোল্ডার ও পরিচালক হিসেবে দাবি করেন, যদিও তাদের প্রকৃত শেয়ার এবং পরিচালক পদে অধিকার করার কোনো আইনগত ভিত্তি ছিল না। অভিযোগে বলা হয়েছে, তারা বিভিন্ন রেজিস্ট্রি ও নথিপত্রে ভুল তথ্য দিয়ে কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদে নিজেদের স্থান নিশ্চিত করেছেন।

অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, ২০১২ সালে সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি) যখন পাবলিক লিমিটেড কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালক হিসেবে কমপক্ষে ২% শেয়ার ধারণ করার শর্ত আরোপ করে, তখন মাত্র দুইজন উদ্যোক্তা শেয়ারহোল্ডার সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন এবং মানজুরুর রহমান এই শর্ত পূর্ণ করেছিলেন। পরে, মানজুরুর রহমান কোম্পানির চেয়ারম্যান পদে আসীন হন। অভিযোগে দাবি করা হয়েছে, এ সময় থেকে তিনি এবং তার পরিবারের সদস্যরা কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদে অবৈধভাবে নিজেদের প্রভাব প্রতিষ্ঠা করেন।

চাকমার অভিযোগ অনুযায়ী, মানজুরুর রহমান কোম্পানির ওপর অবৈধভাবে আধিপত্য বিস্তার করেন এবং কোম্পানির কর্মকর্তাদের ভয়ভীতি দেখিয়ে তাদেরকে নিজের কন্ট্রোলে আনেন। এছাড়া, তিনি জাল তথ্য দিয়ে কোম্পানির বার্ষিক রিপোর্ট এবং অন্যান্য রেজিস্ট্রেশন ফরম পূরণ করেছেন, যা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন ও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে জমা দেওয়া হয়েছিল।

এজাহারে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, সুরাইয়া রহমান, আদিবা রহমান, জিয়াদ রহমান, সাইকা রহমান এবং আনিকা রহমান এসব পদে দায়িত্ব পালন করেছেন ২০১২ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত, এবং তারা অবৈধভাবে কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার হয়ে কোম্পানিতে নিজেরদের পরিবারতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে, যার তদন্ত সম্প্রতি বিভিন্ন চার্টার্ড একাউন্টেন্টস এবং বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (IDRA) কর্তৃক প্রমাণিত হয়েছে।

এছাড়া, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ৩,৬৮৭ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে, যা বিভিন্ন অডিট রিপোর্ট এবং বিশেষ প্রশাসনিক তদন্তে উদঘাটিত হয়েছে। অভিযোগে বলা হয়েছে, আসামিরা এসব অর্থ আত্মসাতের মাধ্যমে কোম্পানির সম্পদকে অপব্যবহার করেছেন।

এখন পর্যন্ত ডেল্টা লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানির পক্ষ থেকে এই বিষয়ে কোনো মন্তব্য করা হয়নি। তবে, বনানী থানা অভিযোগটি গ্রহণ করেছে এবং তদন্ত শুরু করবে বলে জানিয়েছে।   

এদিকে প্রতারণার অভিযোগ তুলে ২০০ ধারায় ডেল্টা লাইফের ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ ৬ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গত ১৭ জানুয়ারি মামলা করেছেন বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ড. এম. মোশাররফ হোসেন। ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের স্থগিত পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আত্মসাৎ ও দুর্নীতি, রাজস্ব ফাঁকি ও অব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ৩ হাজার ৬৮৭ কোটি টাকা ক্ষতি সাধনের অভিযোগ আনা হয়েছে।

একটি নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানের অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদনে বিষয়টি উঠে এসেছে বলে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) জানিয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহকে এ বিষয়ে একটি চিঠি দিয়েছেন আইডিআরএ’র পরিচালক মো. শাহ আলম।  চিঠিতে ৭৪ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনটিও সংযুক্ত করা হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়েছে, ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডে নিয়োগ করা অডিট ফার্ম মেসার্স একনবীন, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টের বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ বরাবর দেওয়া প্রভিশনাল ইন্টেরিম রিপোর্ট পর্যালোচনায় দেখা যায়, এই কোম্পানিতে প্রাথমিকভাবে উদ্‌ঘাটিত ৩ হাজার ৬৮৭ কোটি টাকা অর্থ আত্মসাত ও দুর্নীতি, রাজস্ব ফাঁকি/বকেয়া এবং অব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কোম্পানিটির আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। প্রতিবেদনে মানি লন্ডারিংয়ের মতো অপরাধ সংঘটিত হওয়ার কথাও উল্লেখ রয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *