সেবা খাতে ২০২৩ সালে ঘুষ লেনদেন ১০ হাজার ৯০২ কোটি টাকা, সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি পাসপোর্ট ও বিআরটিএতে

হ-বাংলা নিউজ: টিআইবি (ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশ) এর “সেবা খাতে দুর্নীতি: জাতীয় খানা জরিপ ২০২৩” শীর্ষক প্রতিবেদনে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, সেবা নিতে গিয়ে দেশের জনগণ মোট ৫,৬৮০ টাকা ঘুষ বা নিয়মবহির্ভূত অর্থ পরিশোধ করেছে। জরিপে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি ও ঘুষ লেনদেন পাসপোর্ট সেবা খাতে হয়েছে। ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের টানা ১৫ বছরে সেবা খাতে মোট ১ লাখ ৪৬ হাজার ২৫২ কোটি টাকার ঘুষ লেনদেন হয়েছে।

মঙ্গলবার ঢাকার ধানমন্ডির মাইডাস সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এই প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে, ২০২৩ সালে সেবা খাতে মোট ৭০.৯% খানা দুর্নীতির শিকার হয়েছে। সবচেয়ে বেশি দুর্নীতির শিকার হয়েছে পাসপোর্ট, বিআরটিএ (বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি) এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থায়। একই বছরে গড়ে ৫০.৮% খানা ঘুষের শিকার হয়েছে।

এর মধ্যে, পাসপোর্ট সেবা খাতে সবচেয়ে বেশি ৮৬% খানা দুর্নীতির শিকার হয়েছে, বিআরটিএ-এ ৮৫.২%, এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থায় ৭৪.৫% খানা দুর্নীতির শিকার হয়েছে। এছাড়া, বিচারিক সেবা, ভূমি সেবা, এবং ব্যাংকিং খাতেও ঘুষের পরিমাণ বেশিরভাগ।

প্রতিবেদন অনুসারে, সবচেয়ে বেশি ঘুষ বা নিয়মবহির্ভূত অর্থ নেওয়া হয়েছে বিচারিক সেবা (খানাপ্রতি গড়ে ৩০ হাজার ৯৭২ টাকা), ভূমি সেবা (খানাপ্রতি গড়ে ১১ হাজার ৭৭৬ টাকা), ব্যাংকিং সেবা (খানাপ্রতি গড়ে ৬ হাজার ৬৮১ টাকা) এবং বিআরটিএ (খানাপ্রতি গড়ে ৬ হাজার ৬৫৪ টাকা) খাতে। এছাড়া, যেসব পরিবারের মাসিক আয় ২৪ হাজার টাকার নিচে, তারা বার্ষিক আয়ের ০.৯৩% ঘুষে খরচ করেন, আর মাসিক আয় ৮৫ হাজার টাকার বেশি হলে এই হার ০.২১%।

টিআইবি জানিয়েছে যে, সেবাগ্রহীতারা প্রক্রিয়াগত জটিলতা ও হয়রানির কারণে দুর্নীতি নিয়ে অভিযোগ করতে অনিচ্ছুক। প্রায় ৬০% খানা অভিযোগ জানানোর পদ্ধতি জানে না, এবং যাদের ধারণা আছে, তারা দুদক বা জিআরএস সম্পর্কে খুব কম জানে। এছাড়া, যারা অভিযোগ করেছে, তাদের প্রায় ৫০% ক্ষেত্রে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি, আর ২০% ক্ষেত্রে অভিযোগ গ্রহণই করা হয়নি।

২০২৩ সালে সেবা খাতে ঘুষ লেনদেনের পরিমাণ ছিল ১০ হাজার ৯০২ কোটি টাকা। এর মধ্যে ভূমি খাতে ঘুষের পরিমাণ ২ হাজার ৫১৩ কোটি টাকা, বিচারিক সেবা ২ হাজার ৩৫৭ কোটি টাকা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থেকে সেবা পেতে ১ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা, এবং পাসপোর্ট সেবা পেতে ১ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা ঘুষ দেওয়া হয়েছে।

এই জরিপে অংশগ্রহণকারী ১৫,৫১৫টি পরিবার ৮টি বিভাগ থেকে এসেছে, যা গ্রাম ও শহরাঞ্চলের মিশ্র উপাদান। জরিপটি ১৩ মে থেকে ৩ আগস্ট ২০২৩ পর্যন্ত পরিচালিত হয়।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, জরিপের ফলাফল সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে যেন সেবা খাতে দুর্নীতি কমাতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়। তিনি বলেন, বিচারিক সেবা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোর ক্ষেত্রে দুর্নীতি এবং ঘুষের উচ্চ হার সাধারণ মানুষের ন্যায়বিচার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা সৃষ্টি করছে।

টিআইবির সুপারিশ:

১. দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে দুদক এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমকে আরও সক্রিয় করতে হবে।

২. সেবা পুরোপুরি ডিজিটাইজ করা উচিত, যাতে সেবাগ্রহীতার সঙ্গে সেবাদাতার সরাসরি যোগাযোগের প্রয়োজন না হয়। অনলাইনে সেবা গ্রহণে উৎসাহিত করতে প্রচারণা চালানো প্রয়োজন।

৩. সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানে যুগোপযোগী আচরণবিধি প্রণয়ন করতে হবে, যাতে সেবাগ্রহীতাদের সঙ্গে সঠিক আচরণ ও সেবা সময়মতো দেওয়া হয়।

৪. সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মীদের মেধা ও দক্ষতার ভিত্তিতে পদোন্নতি এবং পদায়ন করা, দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের পদোন্নতি বন্ধ করা।

৫. সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানে ‘ওয়ান স্টপ সার্ভিস’ চালু এবং এটি কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা।

৬. অভিযোগ নিরসনব্যবস্থার প্রচারণা চালানো এবং অভিযোগ জানানোর ব্যবস্থা সহজ করা।

৭. সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে গণশুনানি এবং সামাজিক নিরীক্ষা নিয়মিতভাবে পরিচালিত করা।

৮. সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানে সম্পদবিবরণী জমা দেওয়ার ব্যবস্থা করা, এবং এটি নিয়মিতভাবে হালনাগাদ করা।

৯. দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনগণের সচেতনতা বাড়াতে স্থানীয় পর্যায়ে সামাজিক আন্দোলন জোরদার করতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *