অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রথম ১০০ দিনে প্রশাসনে কাজের অগ্রগতি ও অসন্তোষ

হ-বাংলা নিউজ: 

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রথম ১০০ দিনে প্রশাসনে বেশ কিছু কাজ বাস্তবায়িত হয়েছে, যার মধ্যে কিছু ছিল গতানুগতিক, আবার কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনও আনা হয়েছে। তবে বর্তমান সরকারের কর্মকাণ্ডের বেশিরভাগই পূর্ববর্তী সরকারের সিদ্ধান্তের ধারাবাহিকতায় পরিচালিত হয়েছে। এর মধ্যে কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী এখনও পূর্ণ সন্তুষ্টি পায়নি এবং তারা হতাশ। বেশ কিছু বিষয়ে দ্রুত পরিবর্তনের আশা থাকলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি, ফলে মনোবেদনা সৃষ্টি হয়েছে। অস্থিরতা এবং দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় কাজ আটকে যাওয়ার ফলে, সরকারের ত্বরিত কাজের ইচ্ছা পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি।

গণমাধ্যমের সূত্রে জানা যায়, গত ১০০ দিনে প্রশাসনে অনেক কর্মকর্তা পদোন্নতি পেয়েছেন, এবং বেশ কিছু পুরনো চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে। নতুন চুক্তিভিত্তিক নিয়োগও দেওয়া হয়েছে। এ সময়, অবসরে চলে যাওয়া এবং পদোন্নতির জন্য বঞ্চিত কর্মকর্তাদের ক্ষতি মেটাতে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বৃদ্ধি, প্রতিবছর সম্পদবিবরণী দাখিল বাধ্যতামূলক করার উদ্যোগ এবং প্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে। তবে এসব উদ্যোগের মধ্যে এখনও কিছু গুরুত্বপূর্ণ দাবি পূর্ণ হয়নি, যেমন উপসচিব, যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতি এবং অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদোন্নতি।

এছাড়া, নন-ক্যাডার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদনাম পরিবর্তন এবং অন্যান্য দাবিগুলি পূর্ণ না হওয়ায়, তাদের মধ্যে মনোবেদনা বেড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রশাসনে অনেক কাজ হলেও শৃঙ্খলা ও গতির অভাব রয়েছে। যদি প্রশাসনকে দ্রুত কার্যকর না করা যায়, তবে জনস্বার্থে সমস্যা তৈরি হতে পারে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মূল্যায়ন:

এ বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. মোখলেস উর রহমান গণমাধ্যমের সঙ্গে আলোচনা করতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন। তবে জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া জানান, গত ১০০ দিনে যথেষ্ট কাজ হয়েছে এবং সরকারকে প্রশংসা করেছেন। তিনি বলেন, এসব কাজ মূলত জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের রুটিন কার্যক্রম, তবে দুর্নীতির সহায়ক আইন ও বিধিমালা এখনও সংশোধন হয়নি এবং প্রশাসনে বিরাজমান অস্থিরতা এখনও দূর হয়নি। এর ফলে, প্রশাসনে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয়নি এবং কাজের গতিও আসেনি, যা জনস্বার্থে বাধা সৃষ্টি করছে।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রথম দিকের অস্থিরতা:

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর ৮ আগস্ট নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। নতুন সরকার গঠন হওয়ার পরই প্রশাসনে দেখা দেয় ব্যাপক বিশৃঙ্খলা। সচিবালয়ে ক্যাডার এবং নন-ক্যাডার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হয়, তারা বিভিন্ন দাবিতে মিছিল, মিটিং ও সমাবেশ করতে থাকে। সরকার পতনের পর জনপ্রশাসন সচিবসহ বেশ কিছু সচিব অফিসে অনিয়মিত হয়ে পড়েন এবং কর্মকর্তারা একে অপরের প্রতি অগোচরে চলে যান।

এ পরিস্থিতির মধ্যেই ১৯৮২ ব্যাচের কর্মকর্তা ড. মো. মোখলেস উর রহমানকে দুই বছরের জন্য সিনিয়র সচিব হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তিনি দায়িত্ব গ্রহণের পর পদোন্নতির জন্য তিনটি স্তরের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এর ফলে, ১২৫ জন সিনিয়র সহকারী সচিব উপসচিব, ২২৬ জন উপসচিব যুগ্মসচিব এবং ১৩৫ জন যুগ্মসচিবকে অতিরিক্ত সচিব হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়। এছাড়া, ১২ জন কর্মকর্তাকে সিনিয়র সচিব বা সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয় এবং গ্রেড-১ পদে ৩ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়।

চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ এবং বঞ্চিত কর্মকর্তাদের ক্ষতিপূরণ:

গত সরকারের সময় যেসব চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল, সেগুলির বেশিরভাগই বাতিল করা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছেন সচিব থেকে রাষ্ট্রদূত পদমর্যাদার কর্মকর্তারাও। একই সঙ্গে, ৮০ জন নতুন চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছেন, যারা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে নিয়োগ পেয়েছেন। তবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের বিষয়ে কর্মরত কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে। তাদের অভিযোগ, একটি চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ধাক্কা সহকারী সচিব পর্যন্ত পৌঁছে যায়, যা আর বন্ধ হওয়া উচিত।

বঞ্চিত কর্মকর্তাদের ক্ষতি পুষিয়ে দিতে সাবেক অর্থসচিব জাকির আহমেদ খানের নেতৃত্বে একটি পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি আবেদন গ্রহণ করে যাচাই-বাছাই করছে এবং প্রাথমিক তালিকা তৈরি করেছে, যার মধ্যে প্রায় ১,৫০০ আবেদনকারীকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

সম্পদবিবরণী এবং সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা:

এছাড়া, সরকারি কর্মচারীদের সম্পদবিবরণী দাখিলের বিষয়ে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সাড়ে ১৬ লাখ সরকারি কর্মচারীকে প্রতিবছর বাধ্যতামূলকভাবে সম্পদবিবরণী দাখিল করতে হবে। তবে এই ব্যবস্থাপনার কার্যকারিতা নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা সন্দিহান, কারণ কার্যকর পদক্ষেপ এখনও গৃহীত হয়নি।

সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩২ বছর নির্ধারণ করা হলেও, দীর্ঘদিন ধরে চাকরিপ্রত্যাশীরা বয়সসীমা বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলন করে আসছিলেন। ৩০ সেপ্টেম্বর চাকরি প্রত্যাশীরা মিছিলসহ প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে বসে পড়েন এবং পুলিশ সাথে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। পরবর্তীতে, প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশে একটি কমিটি গঠন করা হয় এবং ৩২ বছর বয়সসীমা বৃদ্ধির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তবে এখনও এই সিদ্ধান্তের গেজেট প্রকাশ হয়নি।

প্রশাসন সংস্কার এবং তদন্ত:

প্রশাসন সংস্কার কমিশনও গঠন করা হয়েছে, যার নেতৃত্বে রয়েছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী। এই কমিশন আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সুপারিশ সরকারের কাছে পেশ করবে। এর পাশাপাশি, জেলা প্রশাসক নিয়োগে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ডিসি নিয়োগে আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হলেও, তদন্তে কিছু ভুল পরিচালনার কারণে প্রশাসনে খারাপ দৃষ্টান্ত তৈরি হয়েছে।

অতীত অস্থিরতা ও মনোবেদনা:

এতসব কাজের পরেও প্রশাসনে বেশ কিছু অসমাপ্ত কাজ রয়েছে, যার কারণে ক্যাডার এবং নন-ক্যাডার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে মনোবেদনা রয়েছে। বিশেষত, সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বৃদ্ধি করা হলেও, অবসরের বয়সসীমা এখনও বাড়ানো হয়নি, যা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি করেছে। এছাড়া, নন-ক্যাডার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদনাম পরিবর্তনসহ অন্যান্য দাবির পূরণ না হওয়ায় তাদের মধ্যে অসন্তোষ বজায় রয়েছে।

কর্মচারী নেতারা দাবি করেছেন, এই সমস্যাগুলোর সুরাহা না হলে প্রশাসনে আরও অস্থিরতা সৃষ্টি হতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *