Title: পাকিস্তান থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে সরাসরি জাহাজ চলাচল: বাংলাদেশ-পাকিস্তান বাণিজ্যের নতুন সম্ভাবনা

হ-বাংলা নিউজ: 

সম্প্রতি পাকিস্তানের করাচি থেকে একটি কন্টেইনার বহনকারী জাহাজ সরাসরি চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছানোর ঘটনা ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি করেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর প্রথমবারের মতো পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে সরাসরি জাহাজ চলাচলের ঘটনা, যা দুই দেশের বাণিজ্য সম্পর্কের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে।

বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে, যেখানে বাংলাদেশ-পাকিস্তান বাণিজ্য সম্পর্কের সম্প্রসারণ এবং বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর সম্ভাবনা নিয়ে বিশদ আলোচনা করা হচ্ছে। যদিও দুই দেশের মধ্যে দূরত্ব একটি চ্যালেঞ্জ, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে উভয় দেশের বাণিজ্য বৃদ্ধি সম্ভব।

বাণিজ্য গবেষকরা এবং আমদানি-রপ্তানি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সরাসরি জাহাজ ও বিমান চলাচল শুরু করার পাশাপাশি, দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি, মান নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলোর মধ্যে সার্টিফিকেট গ্রহণ প্রক্রিয়া সহজীকরণ এবং পারস্পারিক বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে বাণিজ্য বহুগুণ বৃদ্ধি করা সম্ভব। তাদের মতে, এর ফলে উভয় দেশই লাভবান হতে পারে।

অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম জানিয়েছেন, বাংলাদেশ-পাকিস্তান বাণিজ্য বৃদ্ধির জন্য একটি যৌথ কারিগরি দল গঠন করা যেতে পারে, যা নতুন বাণিজ্য চুক্তির বাস্তবায়ন ও বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে।

বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মো. আইনুল ইসলাম বলেন, পাকিস্তান সরকার বাংলাদেশের জন্য ভিসামুক্ত সফরের ঘোষণা দিয়েছে, যা বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তার মতে, এটি দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির সুযোগ তৈরি করেছে।

বাণিজ্যের পণ্যসমূহ:

করাচি থেকে সরাসরি চট্টগ্রাম বন্দরে আসা জাহাজে যেসব পণ্য বাংলাদেশে এসেছে, তার মধ্যে রয়েছে ফ্যাব্রিকস, চুনাপাথর, সোডা অ্যাশ, পেঁয়াজ, ম্যাগনেসিয়াম কার্বনেট ও ডোলোমাইট, যা প্রধানত টেক্সটাইল শিল্পের কাঁচামাল। পাকিস্তান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে পাকিস্তান বাংলাদেশে প্রায় ৬৫ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। এর মধ্যে রপ্তানির প্রধান পণ্য ছিল সুতা-কাপড় ও প্রস্তুত চামড়া।

অন্যদিকে, বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানে রপ্তানি পরিমাণ ছিল ৬ কোটি ডলারের কিছু বেশি। বাংলাদেশ প্রধানত কাঁচা পাট, ওষুধ, হাইড্রোজেন পার অক্সাইড, চা ও তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছে।

গত ২০২২ সালে বাংলাদেশ ৭৪ মিলিয়ন ডলারের রপ্তানি করেছে, কিন্তু পাকিস্তান থেকে আমদানি করেছে প্রায় ৮৪০ মিলিয়ন ডলারের পণ্য, যা বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানে রপ্তানির দশগুণ। পাকিস্তান থেকে সবচেয়ে বেশি আমদানি হয়েছে তুলা, এবং উল্লেখযোগ্য পরিমাণে সিমেন্টের কাঁচামালও এসেছে।

নতুন বাণিজ্য সম্ভাবনা:

ড. আইনুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ থেকে কৃষিপণ্য, গার্মেন্টস, মেডিসিন, এবং লেদার পণ্য রপ্তানি বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। অন্যদিকে, পাকিস্তানের সিলিং ফ্যান, ফল, জুস, এবং মেয়েদের পোশাক বাংলাদেশে জনপ্রিয়। তিনি মনে করেন, কস্ট বেনিফিট পর্যালোচনা করে উভয় দেশই লাভবান হতে পারে।

গবেষক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, দুই দেশের মধ্যে পণ্যের চাহিদা বিশ্লেষণ করে নতুন বাণিজ্য সুযোগ তৈরি করা যেতে পারে। তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেন, পাকিস্তান থেকে কটন বা টেক্সটাইল কাঁচামাল এবং লাইট ইনজিনিয়ারিং পণ্য বাংলাদেশে প্রবাহিত হতে পারে।

বাণিজ্য সম্পর্কের নতুন দিগন্ত:

পাকিস্তানের হাইকমিশনার আহমদ মারুফ আগস্ট মাসে বাংলাদেশের নতুন সরকারের বিভিন্ন প্রতিনিধির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বাণিজ্য সম্পর্ক বাড়ানোর বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন। বিশেষভাবে তিনি সরাসরি বিমান ও জাহাজ চলাচলের ওপর গুরুত্ব দেন। গত ১৩ নভেম্বর পাকিস্তান হাইকমিশন তাদের সোশ্যাল মিডিয়ায় জানায়, সরাসরি জাহাজ চলাচল শুরু হওয়াকে তারা “দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে একটি বড় পদক্ষেপ” হিসেবে বিবেচনা করছে। এই পদক্ষেপটি ট্রানজিট সময় কমিয়ে দেবে এবং নতুন ব্যবসায়িক সুযোগ তৈরি করবে।

গবেষকরা জানান, সরাসরি জাহাজ চলাচল না থাকায়, বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানে পণ্য পরিবহন করতে হয়ে থাকে দুবাই বা শ্রীলংকা হয়ে। এই প্রক্রিয়া বাণিজ্য ব্যয় বাড়ায় এবং সময় বেশি লাগে। তবে বাংলাদেশের রাজস্ব বোর্ডের ২৯ সেপ্টেম্বরের এক সিদ্ধান্তের পর, পাকিস্তান থেকে আসা পণ্য চট্টগ্রাম বন্দরে দ্রুত clearance পাচ্ছে, যা বাণিজ্য বাড়াতে সহায়ক হবে।

শিপিং এজেন্ট এসোসিয়েশনের সভাপতি সৈয়দ আরিফ আহমেদ বলেন, সরাসরি জাহাজ চলাচলের ফলে উভয় দেশের মধ্যে বাণিজ্য আরও বৃদ্ধি পাবে এবং বাংলাদেশ তার রপ্তানি বৃদ্ধি করতে সক্ষম হবে।

নতুন সম্ভাবনা:

ড. গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, এখন উভয় দেশের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত, এবং সরাসরি বাণিজ্য সম্পর্কের মাধ্যমে উভয় দেশই লাভবান হতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *