বাংলাদেশে দীর্ঘদিনের একনায়ক শাসনের অবসান, নতুন অন্তর্বর্তী সরকার ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

হ-বাংলা নিউজ: বাংলাদেশে প্রায় দেড় দশকের একনায়ক শাসনের অবসান ঘটেছে এবং বর্তমানে দেশটি একটি অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে চলছে। এই সরকারের নেতৃত্বে আছেন শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ক্ষমতার এই পরিবর্তনের পর, ঢাকার সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার চেষ্টা চালাচ্ছে বিভিন্ন দেশ, বিশেষ করে প্রতিবেশীরা।

আজ, রোববার (১৫ সেপ্টেম্বর), পাকিস্তানের প্রভাবশালী গণমাধ্যম দ্য ডন একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেছে, যা লিখেছেন আইজাজ আহমদ চৌধুরী। তিনি দক্ষিণ এশিয়ার পরমাণু শক্তিধর দেশটির সাবেক পররাষ্ট্র সচিব এবং ইসলামাবাদের সানোবার ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান।

নিবন্ধটি পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো:

বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে গেছেন। ঢাকার সঙ্গে তার পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা প্রায় দেড় মাস আগে ঘটেছে। এই সময়ের মধ্যে, ছাত্র নেতৃত্বাধীন বিক্ষোভের বিরুদ্ধে হাসিনার সরকারের সহিংস দমন-পীড়ন থেকে বাংলাদেশ ধীরে ধীরে উত্তরণ লাভের চেষ্টা করেছে।

ছাত্র-জনতার ওপর দমন-পীড়নের ফলে এক হাজারেরও বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে বলে জানা যায়। ‘আয়রন লেডি’ হিসেবে পরিচিত শেখ হাসিনা কেন এত দ্রুত ক্ষমতা হারালেন এবং বাংলাদেশের পরিবর্তনের প্রকৃতি কী হবে, তা নিয়ে বৈশ্বিক বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় আগ্রহী।

২০০৯ সাল থেকে হাসিনা স্বৈরাচারের মতো বাংলাদেশকে শাসন করেছেন এবং নির্মমভাবে বিরোধী দলগুলোকে নিপীড়ন করেছেন। তার শাসনে, তার বাবা শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিত্বকে কেন্দ্র করে একটি ধর্মীয় সংস্কৃতি গড়ে তোলা হয়েছিল।

হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতি বাংলাদেশের বহুদলীয় গণতন্ত্রের অবক্ষয় ও একদলীয় শাসন চাপানোর প্রচেষ্টা নিয়ে যে উদ্বেগ ছিল, তা কিছুটা শান্ত করেছে। বাংলাদেশের মানুষ এখন এই পরিবর্তনকে একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হিসেবে দেখছে। পরিবর্তনটির স্থায়ীত্ব এবং দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে কিনা, তা এখনো স্পষ্ট নয়।

হাসিনার দল আওয়ামী লীগ বর্তমানে চাপের মুখে রয়েছে, তবে তারা ফিরে আসার চেষ্টা করবে, কারণ তারা দেশের ধর্মনিরপেক্ষ নীতির প্রতিনিধিত্ব করে। হাসিনার ১৫ বছরের শাসনে তার দল জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিস্তার লাভ করেছে।

হাসিনার অধীনে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক উন্নয়ন দেখেছে, তবে এই উন্নয়ন অন্তর্ভুক্তিমূলক ছিল না এবং বেকারত্ব, মুদ্রাস্ফীতি ও বৈষম্য তীব্র হয়ে ওঠে।

পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে, হাসিনা ভারতীয় আধিপত্যের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন, যা স্বাধীনতাকামী বাংলাদেশিদের জন্য বিরক্তিকর ছিল। বর্তমানে, বাংলাদেশে ভারত চাপের মধ্যে পড়েছে, তবে তারা নিজেদের প্রভাব রক্ষা করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করবে।

বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের নিরাপত্তা ভারতীয় নেতাদের প্রধান উদ্বেগ। তবে, তাদের জন্য তাৎক্ষণিক চ্যালেঞ্জ হলো— হাসিনার উপস্থিতি কীভাবে সামলানো হবে। ২০১৩ সালে উভয় দেশ একটি প্রত্যর্পণ চুক্তি সই করেছিল, এবং সেই চুক্তির আলোকে বাংলাদেশে অনেকেই হাসিনা ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা ৯০টিরও বেশি ফৌজদারি মামলার বিচারের জন্য তাকে ফিরিয়ে আনার আহ্বান জানিয়েছে।

অন্যদিকে, ভারত বাংলাদেশে পরিবর্তনের যে বর্ণনা দিচ্ছে, সেটির অপব্যাখ্যা বা কারসাজি করে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহারের চেষ্টা করছে। ভারতীয় গবেষক ও মিডিয়া এমন একটি বর্ণনার দিকে এগোচ্ছে, যেখানে বলা হচ্ছে— এই রাজনৈতিক পরিবর্তন বাংলাদেশকে মুসলিম মৌলবাদের দিকে ধাবিত করবে এবং বাংলাদেশি হিন্দুদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটছে। যদিও বিবিসির সংবাদ অনুসারে, হামলার এসব খবরের বেশিরভাগই গুজব।

হাস্যকরভাবে, ভারতে ধর্মীয় নিপীড়ন উদ্বেগজনক মাত্রায় বেড়েছে। বাংলাদেশে এই পরিবর্তনের সম্ভাব্য বিদেশি সম্পৃক্ততা নিয়ে ভারত মরিয়া হয়ে উঠেছে, যদিও বাংলাদেশের পরিবর্তন সম্পূর্ণ দেশীয় বলেই মনে হচ্ছে। ছাত্রদের আত্মত্যাগের মাধ্যমে যে পরিবর্তন এসেছে, তা অসম্মানিত করার চেষ্টা ভারতের উদ্দেশ্য হতে পারে।

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের জন্য সংগ্রাম করছে। হাসিনার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু হওয়ার আগে থেকেই অর্থনীতি ধীর গতিতে চলছিল।

বিক্ষোভের কারণে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সরকার একটি টাস্কফোর্স গঠন করেছে, যা ‘অর্থনীতির পুনঃকৌশলীকরণ এবং ন্যায়সঙ্গত ও টেকসই উন্নয়নের জন্য সম্পদ সংগ্রহ’ নিয়ে কাজ করছে।

রাজনৈতিকভাবে এই পরিস্থিতির নিরাময় প্রয়োজন। ছাত্র নেতৃত্ব নির্বাচনের আগে বিচার বিভাগ, পুলিশ ও নির্বাচন কমিশনে মৌলিক সংস্কারের দাবি জানিয়েছে, যা নির্বাচনের কিছুটা বিলম্বিত হতে পারে।

আঞ্চলিক পরিস্থিতির জন্য, ড. মুহাম্মদ ইউনূস সার্ককে পুনরুজ্জীবিত করার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছেন, যা ১৯৮৫ সালে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তিনি চান, বাংলাদেশ আসিয়ানের সদস্য হবে এবং সার্ক ও আসিয়ানের মধ্যে সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করবে।

পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া কী হওয়া উচিত? পাকিস্তান বাংলাদেশের জনগণের রাজনৈতিক অধিকারকে সম্পূর্ণভাবে সম্মানিত করার পক্ষপাতী। পাকিস্তান এই বাস্তবতা থেকে সন্তুষ্ট হতে পারে যে— হাসিনা আর পাকিস্তানকে মিথ্যা দোষারোপ করতে পারবে না বা একাত্তরের দুঃখজনক ঘটনাকে নিয়ে কোনো কারসাজি করতে পারবে না। এছাড়া পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিষাক্ত প্রোপাগান্ডা বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতি পাকিস্তান ও বাংলাদেশের জন্য দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের একটি সুযোগ নিয়ে এসেছে। তবে, পাকিস্তানকে বাস্তবসম্মত প্রত্যাশা রাখতে হবে যে— নতুন অন্তর্বর্তী সরকার তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলো সমাধানের চেষ্টা করছে।

সম্প্রতি বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে ভয়াবহ বন্যার মুখে পাকিস্তান বাংলাদেশের জনগণের প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করেছে। দুই দেশের জনগণের মধ্যে যোগাযোগ ও যুব বিনিময়কে উৎসাহিত করা উচিত, যা হাসিনা বন্ধ করে দিয়েছিলেন।

বাস্তবসম্মত প্রত্যাশা নিয়ে এবং সুনির্দিষ্ট গতিতে একে অপরের দিকে এগিয়ে যাওয়াই হবে উভয় দেশের জন্য উপযুক্ত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *