হ-বাংলা নিউজ:
বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘বিদ্বেষমূলক বক্তব্য’ প্রচারে নিষেধাজ্ঞা এবং সেগুলো সরানোর জন্য আদালত যে নির্দেশ দিয়েছে তা কার্যকর করা বাস্তবে কঠিন হতে পারে, এমন ধারণা প্রকাশ করেছেন সিনিয়র আইনজীবীরা। তারা একে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মন্তব্য করছেন।
বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল শেখ হাসিনার সব ধরনের ‘বিদ্বেষমূলক বক্তব্য’ গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। একই সঙ্গে, এসব বক্তব্য দ্রুত সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) এর মাধ্যমে সরানোর নির্দেশ দিয়েছে আদালত।
প্রসিকিউশনের আবেদনের ভিত্তিতে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন বিচারপতির ট্রাইব্যুনাল এ আদেশ দেয়।
তবে, প্রশ্ন উঠছে যে ‘বিদ্বেষমূলক বক্তব্য’ কীভাবে নির্ধারণ করা হবে? আইনজীবীদের মতে, এটি নির্ধারণ এবং নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়ন করা বেশ কঠিন।
কীভাবে নির্ধারিত হবে?
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশনের মতে, সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেশ কিছু বিদ্বেষমূলক বক্তব্য ছড়িয়ে পড়েছে, যা জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি এবং উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে। এই বক্তব্যগুলো বন্ধ করার জন্য দেশি-বিদেশি তিনটি ‘রেফারেন্স’ এর ভিত্তিতে আবেদন করা হয়েছে। আদালত এসব রেফারেন্সকে আমলে নিয়ে নির্দেশনা প্রদান করেছে।
রেফারেন্সগুলো হল:
- সংবিধানের আর্টিকেল ৩৯
- ইন্টারন্যাশনাল কভেন্যান্ট অন সিভিল এ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটস (আইসিসিপিআর)
- রাবাত প্রিন্সিপ্যাল
আইসিসিপিআর অনুযায়ী, জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে কিছু ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া যেতে পারে, আর রাবাত প্রিন্সিপ্যালে নির্দিষ্ট কিছু বিষয় বিবেচনা করে বক্তব্যকে বিদ্বেষমূলক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
কোন বক্তব্য ‘বিদ্বেষমূলক’?
গত ৫ আগস্ট ক্ষমতার পরিবর্তনের পর শেখ হাসিনার কিছু ফোনালাপ সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। যদিও এসব ফোনালাপের সত্যতা যাচাই করা সম্ভব হয়নি, তবে সেগুলোতে রাজনৈতিক নির্দেশনা প্রদান শোনা গেছে। এসব বক্তব্যকে বিদ্বেষমূলক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন প্রসিকিউটর নোমান।
তিনি উল্লেখ করেন, শেখ হাসিনার বক্তৃতা সাধারণ জনগণকে প্রভাবিত করতে পারে, বিশেষ করে তিনি যে একাধিক গণহত্যা মামলার আসামি, সে কারণে তার বক্তব্য তদন্তের ক্ষেত্রে বাধা হতে পারে।
আইনিভাবে ‘বিদ্বেষমূলক বক্তব্য’ চিহ্নিত করা কঠিন
আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘বিদ্বেষমূলক বক্তব্য’ সংজ্ঞায়িত করা এবং তা কার্যকর করা প্রায় অসম্ভব। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক মনে করেন, এ ধরনের বক্তব্য কীভাবে সংজ্ঞায়িত করা হবে তা স্পষ্ট না থাকলে বিটিআরসি’র পক্ষে এটি বাস্তবায়ন করা কঠিন হবে।
অন্যদিকে, অ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ বলেন, রাজনীতির ক্ষেত্রে বিরোধী দলের প্রতি বিদ্বেষমূলক বক্তব্য স্বাভাবিক। রাজনৈতিক বক্তব্যের মধ্যে বিদ্বেষ খুঁজে বের করা খুবই কঠিন।
এছাড়া, সোসাল মিডিয়ার যুগে, যেমন তারেক রহমানের বক্তব্যের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা সম্ভব হয়নি, তেমনি শেখ হাসিনার বক্তব্যের ক্ষেত্রেও এ নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়ন করা কঠিন হতে পারে, এমন মন্তব্য করেন তারা।
গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের চ্যালেঞ্জ
বিটিআরসি’র দায়িত্ব হলো গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ওপর এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা। তবে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সরাসরি কোন নিয়ন্ত্রণ নেই, যা এই নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নে সমস্যার সৃষ্টি করবে।
প্রসিকিউটর নোমান জানিয়েছেন, তারা আদালতের লিখিত আদেশ পেলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্ল্যাটফর্মগুলোকে চিঠি দিয়ে জানাবেন, কিন্তু এখানে প্রশাসনের কোনো শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণ নেই।
জনমতের প্রতিক্রিয়া
এ বিষয়ে মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন বলেন, ‘যে বক্তব্য মানুষের প্রতি বিদ্বেষ ছড়ায় বা সমাজে অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে, তা সাবধানতার সাথে নিয়ন্ত্রণ করা উচিত। তবে, শেখ হাসিনার অধিকার লঙ্ঘিত না হয়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, সম্প্রতি শেখ হাসিনার যে ধরনের বক্তব্য শোনা যাচ্ছে, সেগুলো সামাজিক অস্থিরতা তৈরি করতে পারে, যা সমাজে সম্প্রদায়িক হানাহানি সৃষ্টি করবে।
উপসংহার
এতসব আইনগত ও বাস্তবিক জটিলতার মধ্যে, এই নিষেধাজ্ঞার বাস্তবায়ন নিয়ে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে। আইনজীবীদের মতে, ‘বিদ্বেষমূলক বক্তব্য’ সংজ্ঞায়িত করা এবং তা কার্যকর করা কঠিন হওয়ায়, এই নিষেধাজ্ঞার প্রভাব গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপরও পড়বে।
